বিরোধীদের আন্দোলনের মধ্যে সংসদ নির্বাচনের তফসিল, ভোট ৭ জানুয়ারি

কামরান রেজা চৌধুরী
2023.11.15
ঢাকা
বিরোধীদের আন্দোলনের মধ্যে সংসদ নির্বাচনের তফসিল, ভোট ৭ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার প্রতিবাদে ঢাকার বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের উত্তর গেট থেকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন (ইসি) ঘেরাও করতে রওনা হলে শান্তিনগর মোড়ে পুলিশ তাদের আটকে দেয়। ১৫ নভেম্বর ২০২৩।
[বেনারনিউজ]

আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০২৩। ইস্টার্ন সময় দুপুর ১:০০

দেশের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি ও তার মিত্রদের প্রচণ্ড বিরোধিতার মধ্যে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। তফসিল অনুযায়ী, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ৭ জানুয়ারি ২০২৪।

বুধবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল এই ঘোষণা দেন। তাঁর বক্তব্য রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং বেতারে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে। অন্যদিকে তফসিল প্রত্যাখ্যান করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল

(বিএনপি)।

বুধবার রাতে অনলাইন ব্রিফিংয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, “বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকলে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের প্রত্যাশা হাস্যকর। দেশের জনগণ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের দাবি উপেক্ষা করে তফসিল ঘোষণা তামাশা মাত্র।”

এই সিদ্ধান্তের পর দেশে যে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে তার দায় সরকারের,” বলেন রিজভী।

প্রসঙ্গত, নয়াপল্টনে বিরোধী দল বিএনপির তালাবদ্ধ কার্যালয়ের সামনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা রয়েছে। এ ছাড়া, বিএনপি কার্যালয় সংলগ্ন নাইটিঙ্গেল মোড় বিপুল সংখ্যক র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যদের দেখা গেছে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।

নির্বাচন কমিশনের (ইসি) তফসিল ঘোষণার প্রতিবাদে আগামীকাল সারাদেশে আধাবেলা হরতালের ডাক দিয়েছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বিরোধী দলগুলো কর্মসূচি ঘোষণা করার কথা জানিয়েছে।

IMG_2260.jpg
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিলকে স্বাগত জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগের আনন্দ মিছিল ও সমাবেশ। ১৫ নভেম্বর ২০২৩। [বেনারনিউজ]

সংলাপের সময় আর নেই: আওয়ামী লীগ

নির্বাচনকালীন সরকার কী হবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক সমঝোতা এখনো হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না বলে আগেই জানিয়ে দিয়েছে বিএনপি ও তার মিত্র দলগুলো।

বিএনপি-জামায়াতসহ সমমনা দলগুলো একটি দল-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে।

গত ২৮ অক্টোবর বিএনপি ও মিত্রদের সরকার-বিরোধী সমাবেশে পুলিশের হামলার পর প্রায় প্রতিদিনই তারা সড়ক অবরোধ কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে।

এর মধ্যে আগামী জাতীয় সংসদ এমন এক সময় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, যখন আওয়ামী লীগ বিরোধী দেশের মূলধারার দুই দল বিএনপি ও জামায়াতের অধিকাংশ শীর্ষস্থানীয় নেতারা সহিংসতাসহ বিভিন্ন অভিযোগে কারাগারে রয়েছেন।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগ বলছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধান বিরোধী এবং দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, শেখ হাসিনার অধীনে হলেও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে। বিরোধীদল সরকারের এই আশ্বাসের ওপর আস্থাশীল নয়।

সরকার ও বিরোধী দলের এই মতবিরোধ দূর করতে কোনোপ্রকার শর্ত ছাড়াই আলোচনায় বসতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির প্রতি আহ্বান জানিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা আগে বুধবার আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সাথে বৈঠক করেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস।

তবে বৈঠক শেষে কাদের সাংবাদিকদের জানান, সংলাপের সময় আর নেই।

IMG_2259.jpg
জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। ১৫ নভেম্বর ২০২৩। [বেনারনিউজ]

সংঘাত ও সহিংসতা পরিহারে আহ্বান জানালেন সিইসি

বিএনপি ইতোমধ্যে লাগাতর হরতাল-অবরোধ ঘোষণা করার ইঙ্গিত দিয়েছে।

নির্বাচনের তফসিল প্রত্যাখ্যান করে বুধবার রাতে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, “জনগণের আন্দোলন দ্রুত আরও ত্বরান্বিত হবে এবং সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হবে।”

তফসিল ঘোষণার বিরোধিতা করে বুধবার বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ থেকে নির্বাচন কমিশন কার্যালয় অভিমুখে যাত্রা করে ইসলামী আন্দোলন। তবে পুলিশের বাধার মুখে সেই পদযাত্রা শান্তিনগরে ভণ্ডুল হয়ে যায়।

ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ৩০ নভেম্বর, বাছাই ১-৪ ডিসেম্বর, রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল ও শুনানি ৬-১৫ ডিসেম্বর এবং ১৭ ডিসেম্বরের মধ্যে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করা যাবে।

জাতির উদ্দেশে ভাষণে সিইসি বলেন, “আমি নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে সকল রাজনৈতিক দলকে বিনীতভাবে অনুরোধ করব, সংঘাত ও সহিংসতা পরিহার করে সদয় হয়ে সমাধান অন্বেষণ করতে।”

জনগণকে অনুরোধ করব, সকল উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও অস্বস্তি পরাভূত করে নির্ভয়ে আনন্দমুখর পরিবেশে ভোটকেন্দ্রে এসে অবাধে মূল্যবান ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে,” বলেন সিইসি।

একাধিক জেলায় সহিংসতা

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণাকে কেন্দ্র করে বুধবার বগুড়ায় আওয়ামী লীগ এবং সিলেটে পুলিশের সাথে বিএনপি সমর্থকদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।

বগুড়ার শেরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বাবু কুমার সাহা বুধবার বেনারকে বলেন, শেরপুর শহরে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মিছিল মুখোমুখি হলে সংঘর্ষ শুরু হয়, এতে দুই দলের মোট ২০ জনসহ পাঁচ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন।

প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়, বুধবার সন্ধ্যা সোয়া ছয়টার দিকে সিলেট নগরের জিন্দাবাজার এলাকায় বিএনপি সমর্থকরা মশালমিছিল বের করলে পুলিশ ফাঁকা গুলি ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।

এ সময় একজনকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। সন্ধ্যা সাতটার দিকে সিলেট শহরে ছাত্রলীগের কর্মীরা মোটরসাইকেল মহড়া দিয়েছেন।

বুধবার চাঁদপুরে কমপক্ষে ২০টি গাড়ি ভাংচুর হয়েছে বলে ডেইলি স্টার অনলাইনের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

এছাড়া গাজীপুর মহানগরের ভুরুলিয়া এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথে, সিলেটে একটি লেগুনায় এবং বগুড়ায় একটি কনটেইনারবাহী লরিতে বুধবার রাতে দুর্বৃত্তরা আগুন দিয়েছে বলেও জানানো হয় ওই প্রতিবেদনে।

‘পরিস্থিতি সহিংসতার দিকে যাচ্ছে’

নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার মাধ্যমে দেশের পরিস্থিতি সহিংসতার দিকে যাচ্ছে বলে বুধবার বেনারের কাছে মন্তব্য করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক নিজাম উদ্দিন আহমেদ।

তিনি বলেন, “সরকারের পক্ষ থেকে বিরোধীদলের কাছে গ্রহণযোগ্য কিছু না দিলে, তফসিল ঘোষণার পর দুই দলের মধ্যে রাজনৈতিক মীমাংসা হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।”

“বিরোধীদের আলোচনার টেবিলে আনতে হলে সরকারকেই ছাড় দিতে হবে। অন্যথায় তারা সহযোগিতা করবে না রাজপথে সহিংসতাসহ হরতাল, অবরোধ অব্যাহত রাখবে,” বলেন অধ্যাপক নিজাম।

তিনি বলেন, “সরকার বিরোধীদলকে আস্থায় না নিলে আমরা আরেকটি প্রধান বিরোধীদলবিহীন একতরফা নির্বাচনের দিকে ধাবিত হচ্ছি। যা দেশের জন্য খুব খারাপ হবে।”

“হরতাল, অবরোধ এবং সহিংস কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি পঙ্গু হবে এবং এর ফলে দেশের মানুষকে ভুগতে হবে,” যোগ করেন তিনি।

...............

আপডেট: প্রতিবেদনে বিভিন্ন স্থানে সহিংসতার তথ্য যোগ করা হলো।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।