বিরোধী দলের সন্ধানে সরকারি দল

কামরান রেজা চৌধুরী
2023.11.16
ঢাকা
বিরোধী দলের সন্ধানে সরকারি দল নির্বাচনী তফসিল বাতিল করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বাম গণতান্ত্রিক জোটের ডাকা অর্ধদিবস হরতাল চলাকালে ঢাকার পুরোনো পল্টন এলাকায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যদের টহল। ১৬ নভেম্বর ২০২৩ ।
[বেনারনিউজ]

রাজপথে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির বয়কটের ঘোষণা এবং সংসদীয় বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সংসদ নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব সরকারি দল আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে নতুন প্রতিপক্ষ খুঁজতে উদ্বুদ্ধ করছে। 

বাম ও ছোটখাটো মিলিয়ে ১৩টি দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটে আছে।

সদ্য নিবন্ধন পাওয়া রাজনৈতিক দল তৃণমূল বিএনপি এবং স্বতন্ত্র জোট নামে নতুন একটি জোটকে নির্বাচনে সরকারি দলের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা লক্ষ করছেন রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা।

বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত কয়েকজন নেতা গড়ে তুলেছেন তৃণমূল বিএনপি ও স্বতন্ত্র জোট। এদের কেউ তৃণমূল বিএনপি, কেউ জোটের অধীনে এবং কেউ কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করবেন।

ক্ষমতাসীন দল ও তাদের মিত্রদের মতে, বিএনপি-জামায়াত নির্বাচনে না এলেও নির্বাচন বৈধ হবে; যদি জনগণ ভোটকেন্দ্রে আসে।

তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জাতীয় পার্টি নির্বাচনে না গেলে ক্ষমতাসীনদের অবস্থান আরেকটু দুর্বল হবে। তবে বিএনপি ছাড়া কোনো নির্বাচনই দেশে এবং আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্য হবে না।

বুধবার সন্ধ্যায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। আগামী বছরের ৭ জানুয়ারি এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

বৃহস্পতিবার স্থানীয় গণমাধ্যম প্রথম আলোর অনলাইন ভার্সনে প্রকাশিত খবর অনুসারে, দেশের নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ১৭টি দলই এই তফসিল প্রত্যাখ্যান করেছে, স্বাগত জানিয়েছে ১৫টি দল। বাকি ১২টি দল তফসিলের বিষয়ে নিজেদের অবস্থান এখনো স্পষ্ট করেনি।

দ্বিধায় ভুগছে জাতীয় পার্টি

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক মিত্র এবং সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি জানিয়েছে, দলটি ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে দ্বিধায় ভুগছে। দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বৃহস্পতিবার বেনারকে এই অবস্থানের কথা জানান।

প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একই রকম রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে সরকারকে অনেকটা বৈধতা দিয়েছিল জাতীয় পার্টি।

জাতীয় পার্টি আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কি না জানতে চাইলে মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, “আমরা দ্বিধাগ্রস্ত। এখনো সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি; নির্বাচনে যাব কি না। কারণ আমরা সর্বশেষ ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লক্ষ্মীপুরে উপনির্বাচনে যা দেখলাম, তাতে বিরোধী দল অংশ না নিলে জনগণ ভোটকেন্দ্রে আসবে না। কেবলমাত্র আওয়ামী লীগের যারা ব্যালটে সিল মারবে তারাই কেন্দ্রে যাবে।”

নির্বাচন হতে হবে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এখনো সময় আছে। আমরা সভা করে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব।”

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা. সাখাওয়াত হোসেন সায়ান্থ বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “বিএনপি ছাড়া কেবল জাতীয় পার্টি নির্বাচনে গেলে তা মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে—এমন নয়। তবে জাতীয় পার্টি অংশগ্রহণ করলে সরকারের কিছুটা মুখরক্ষা হবে।”

তিনি আরও বলেন, “জাতীয় পার্টি যদি নির্বাচনে না যায়, তাহলে সেটি আওয়ামী লীগের জন্য হবে বড়ো ধাক্কা। সম্প্রতি দলটির তৃণমূল নেতাদের যে সভা হয়েছে, সেখানে স্থানীয় পর্যায়ের প্রায় সব নেতা বিএনপিকে বাইরে রেখে নির্বাচনে না যাওয়ার পক্ষে মতামত দিয়েছেন। কিন্তু দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে যাঁরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করে এমপি, মন্ত্রী হয়েছেন, তাঁরা কিছুটা দ্বিধায় আছেন।”

জাতীয় পার্টি দর কষাকষি করছে

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. নিজাম উদ্দিন আহমেদের মতে, “শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নেবে। তারা বোঝার চেষ্টা করছে, বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে কি না। যদি বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেয়, তখন তারা সব আসনে প্রার্থী দেবে।”

তিনি বলেন, “তারা (জাপা) কোনো অবস্থাতেই বিএনপির পথ অনুসরণ করে নির্বাচন বয়কট করবে না। যদি তারা নির্বাচন বয়কট করে সে ক্ষেত্রে তৃণমূল বিএনপি জাতীয় পার্টির অবস্থান নিয়ে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে, যেটি তারা হতে দেবে না।”

জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগ বিরোধী কথা-বার্তা বলে “জনগণের কাছে জনপ্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে,” মন্তব্য করে অধ্যাপক নিজাম বলেন, “যদি বিএনপি অংশ নেয়, সে ক্ষেত্রে তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিত্রতা করে সিট ভাগাভাগির মাধ্যমে নির্বাচনে যেতে পারে।”

“তবে জাতীয় পার্টি যদি সত্যিই নির্বাচনে অংশ না নেয়, তাহলে বুঝতে হবে আমাদের জন্য গভীর সমস্যা ও সংকট অপেক্ষা করছে,” বলেন অধ্যাপক নিজাম।

তিনি আরও বলেন, “কোনো বড়ো দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক বা না করুক, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার বিষয়ে আশাবাদী। মনে রাখতে হবে, ভারত, চীন, রাশিয়া, জাপানসহ কয়েকটি বড়ো দেশ এই সরকারকে সমর্থন করছে।”

আলোচনায় তৃণমূল বিএনপি-স্বতন্ত্র গণতন্ত্র মঞ্চ

আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নির্বাচনকেন্দ্রিক ভাবনার মধ্যে আলোচনায় এসেছে তৃণমূল বিএনপি ও স্বতন্ত্র গণতন্ত্র মঞ্চের নাম।

বিএনপির বর্তমান ও সাবেক ১২৫ নেতার নেতৃত্বে গঠিত ‘স্বতন্ত্র গণতন্ত্র মঞ্চ’ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দিয়েছে।

গত বুধবার এক সংবাদ সম্মেলন থেকে এ ঘোষণা দেওয়ার পরেই কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য পদ থেকে খন্দকার আহসান হাবিবকে বহিষ্কার করে বিএনপি।

ওই সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপির নির্বাহী কমিটির আরেক সদস্য ব্যারিস্টার এ কে এম ফখরুল ইসলাম।

নির্বাচনের কয়েক মাস আগে রাজনৈতিক দল হিসেবে কমিশনের নিবন্ধন পায় ‘অচেনা’ দল তৃণমূল বিএনপি।

দলটির সভাপতি শমশের মবিন চৌধুরী জানিয়েছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাঁর দল অংশ নেবে।

666fc8f7-47e2-4e10-b732-ab075aba442f.jpg
দলীয় সরকারের অধীনে একতরফাভাবে তফসিল ঘোষণার প্রতিবাদে চট্টগ্রামে নির্বাচন কমিশন অভিমুখে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের গণমিছিল নগরীর বিআরটিসি এলাকায় আটকে দেয় পুলিশ। ১৬ নভেম্বর ২০২৩। [বেনারনিউজ]

চলছে হরতাল, গাড়িতে আগুন

তফসিল ঘোষণার প্রতিবাদে বাম গণতান্ত্রিক জোট বৃহস্পতিবার অর্ধদিবস হরতাল পালন করেছে। আগামী রোববার ও সোমবার আবারও ৪৮ ঘণ্টার হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি।

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার প্রতিবাদে বিএনপি ঘোষিত অবরোধ চলাকালে বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে যানবাহনে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

বুধবার রাতে প্রথমবারের মতো টাঙ্গাইলের ঘারিন্দা রেলওয়ে স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ট্রেনে অগ্নিসংযোগ করা হয়। তবে হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।

এছাড়া, ঢাকার দোহার, টাঙ্গাইল, ঝালকাঠি, নাটোর, বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর ও সিলেটে মোট ১২টি যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।

আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে উৎসব

সরকার পতনের একদফা দাবিতে বিএনপিসহ যুগপৎ আন্দোলনের শরিকরা বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে থাকলেও ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে। সেখানে ছিল উৎসবমুখর পরিবেশ। নেতাকর্মীরা সেখানে খিচুড়ি খেয়েছেন।

অন্যদিকে বিএনপি কার্যালয় এখনো তালাবদ্ধ। কার্যালয়ের সামনে ছিল পুলিশ প্রহরা।

তফসিল ঘোষণার পরে বৃহস্পতিবার প্রথম সংবাদ সম্মেলন করেছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

তিনি বলেন, “এবার অনেক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। সবাইকে নিয়ে নির্বাচন করতে চাই। সময় আছে, নির্বাচনে অংশ নিন।”

কাদের আরও বলেন, “বিএনপিও যদি মত পরিবর্তন করে, নির্বাচন করে, তাহলে তাদের স্বাগত জানানো হবে।”

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শাজাহান খান বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “বিএনপি-জামায়াত এলেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে, না এলে হবে না—এটি ঠিক নয়। জনগণ যদি কেন্দ্রে এসে ভোট দেয় তাহলে কোন দল নির্বাচনে এলো, কোন দল এলো না; সেটি বড়ো ব্যাপার নয়। ”

তবে সাখাওয়াত হোসেন সায়ান্থ বলেন, “বাংলাদেশে নির্বাচনভিত্তিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আর ছিটে ফোঁটাও নেই। নির্বাচনের নামে রাজনীতিতে এক অনিশ্চিত যাত্রা শুরু হতে যাচ্ছে, যা কোথায় কীভাবে শেষ হবে, কেউ জানে না।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।