সংসদ নির্বাচন: এবার জাতীয় পার্টির সাথে আসন ভাগাভাগি করবে না আওয়ামী লীগ

কামরান রেজা চৌধুরী
2023.12.07
ঢাকা
সংসদ নির্বাচন: এবার জাতীয় পার্টির সাথে আসন ভাগাভাগি করবে না আওয়ামী লীগ আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার ছবিসহ ঢাকায় মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের একটি সংসদ নির্বাচনী প্রচারণা। ২১ ডিসেম্বর ২০০৮। টানা তিনটি সংসদ নির্বাচন জোটবদ্ধভাবে করলেও আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আলাদাভাবে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দল দুটি।
[এএফপি]

জাতীয় পার্টির সাথে গত তিনটি সংসদ নির্বাচনে আসন ভাগাভাগি করলেও আসন্ন নির্বাচনে আসন ভাগাভাগি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ।

বুধবার রাতে জাতীয় পার্টির প্রতিনিধিদলের সাথে সভার পর বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু সাংবাদিকদের এ কথা জানান।

২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের সাথে আসন ভাগাভাগি করে নির্বাচন করে আসছে জাতীয় পার্টি।

তবে বিশ্লেষকদের মতে, অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক চাপের প্রেক্ষাপটে আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত ও নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করতেই মূলত এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

আওয়ামী লীগের সাথে বুধবারের বৈঠকের ব্যাপারে জাতীয় পার্টি মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “বৈঠকে আমরা আসন ভাগাভাগির কথা বলিনি, এ নিয়ে আলোচনা করিনি এবং সেটি বলার প্রয়োজনও বোধ করিনি।”

“আমাদের মূল কথা হলো, আগামী সংসদ নির্বাচন যেন অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ হয়। ভোটাররা যেন ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হয় সরকারি দলকে সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বলেছি,” বলেন চুন্নু।

জাতীয় পার্টি প্রায় সবকটি আসনে নিজেদের প্রার্থী দিয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগের সাথে আমাদের প্রার্থীদের শক্ত প্রতিযোগিতা হবে।”

এদিকে জাতীয় পার্টির সাথে আওয়ামী লীগ আসন ভাগাভাগি করবে না বলে বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের জানান দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

বৈঠকে সিট ভাগাভাগির বিষয়ে “কোনো আলোচনা হয়নি,” জানিয়ে তিনি বলেন “আমরা রাজনৈতিক আলোচনা করেছি।”

নির্বাচনমুখী দলগুলোর মধ্যে সমন্বয় থাকা প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

জাতীয় পার্টির সাথে আসন ভাগাভাগি না করলেও ২০০৬-০৭ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকার বিরোধী মহাজোটের অন্যান্য শরিকদলের সাথে আসন ভাগাভাগি করার কথা বলছে আওয়ামী লীগ।

ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে এ বিষয়ে বামপন্থী দল ওয়ার্কার্স পার্টি প্রধান রাশেদ খান মেনন, জাসদ (ইনু) প্রধান হাসানুল হক ইনু, সাম্যবাদী দলের প্রধান দিলীপ বড়ুয়াসহ অন্যান্য ছোট ছোট দলের নেতারা বৈঠক করেছেন।

তাঁরা আওয়ামী লীগের প্রতীক নৌকা নিয়ে নির্বাচন করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে আসছেন, এবারও নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করতে চান।

আওয়ামী লীগের কাছ থেকে শরিক দলের নেতারা ২০টি আসন চেয়েছেন। গতবার তাঁরা পেয়েছিলেন ১০টি আসন। কিন্তু এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

গত ২৬ নভেম্বর শরিকদের জন্য মাত্র দুটি আসন ফাঁকা রেখে ২৯৮টি আসনে নিজেদের প্রার্থী ঘোষণা করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।

a9162fa8-f5e0-4384-8766-9d19d1ca91d0.jpg
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন নিতে ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগ দলীয় কার্যালয়ের সামনে প্রার্থীদের ভিড়। ১৮ নভেম্বর ২০২৩। [বেনারনিউজ]

জাতীয় পার্টির সাথে আঁতাত থাকবে আওয়ামী লীগের?

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমদের মতে, “আন্তর্জাতিক চাপের মুখে এবার আওয়ামী লীগের মূল লক্ষ্য হবে ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিত দেখানো। সেজন্য জনসাধারণের মধ্যে একটি প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের আবহ তৈরি করাই তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।”

এই কারণেই আওয়ামী লীগ মনোনয়ন না পাওয়া দলীয় নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচনে অংশ নিতে উৎসাহ দিয়েছে জানিয়ে বৃহস্পতিবার তিনি বেনারকে বলেন, “স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখবে।”

“জাতীয় পার্টির সাথে আসন ভাগাভাগি করলে মানুষ ভোটকেন্দ্রে যেতে আগ্রহী হবে না। ...তারা আলাদাভাবে নির্বাচন না করলে পুরো নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে,” বলেন অধ্যাপক নিজাম।

তাঁর মতে, প্রকাশ্যে আসন ভাগাভাগির কথা না বললেও “প্রকৃতপক্ষে জাতীয় পার্টির সাথে আওয়ামী লীগের একটি রাজনৈতিক আঁতাত আছে।”

প্রসঙ্গত, কিশোরগঞ্জ জেলার তাড়াইল-করিমগঞ্জ আসনে জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নুর মনোনয়ন বৈধ হলেও আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থীর প্রার্থীতা বাতিল হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে।

জাতীয় পার্টি-আওয়ামী লীগ পুরনো সখ্য

১৯৮২ সালের মার্চে এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বিএনপি দলীয় রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে সরিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেন তৎকালীন সেনাপ্রধান লে. জেনারেল এইচ. এম. এরশাদ।

এরশাদ সরকারের অধীনে ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করলেও বর্জন করে বিএনপি।

তবে দুই বছর কম সময়ের মধ্যে সংসদ থেকে পদত্যাগ করে প্রধান বিরোধীদল আওয়ামী লীগ এবং তার মিত্র দলগুলো।

১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসলে দুর্নীতি মামলায় কারারুদ্ধ হন জেনারেল এরশাদ, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে কারামুক্ত হন তিনি।

২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সালের শেষ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সাথে সরাসরি কোনো আন্দোলনে থাকেনি জাতীয় পার্টি। তবে ২০০৭ সালের ১০ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত মহাজোটে যোগ দেয় দলটি।

২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার দুই বছরের মাথায় ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহাজোটের অংশ হিসাবে আওয়ামী লীগের সাথে আসন ভাগাভাগি করে জাতীয় পার্টি। তখন জাতীয় পার্টির পক্ষে মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন বেসামরিক বিমান ও পরিবহন মন্ত্রী জি এম কাদের, যিনি এখন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান।

বিএনপি-জামায়াতের বর্জনের মধ্যে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের সাথে ঐক্য করে আসন ভাগাভাগি করে নির্বাচনে অংশ নেয় জাতীয় পার্টি।

দলের সংসদ-সদস্যরা বিরোধী দলের সদস্য হলেও তিন জন মন্ত্রী হিসাবে কাজ করেন। রওশন এরশাদ হন সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা।

২০১৮ সালে বিএনপি-জামায়াত ভোটে অংশ নিলে আওয়ামী লীগের সাথে আসন ভাগাভাগি করে নির্বাচন করার পর সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে জাতীয় পার্টি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।