নিখোঁজ বিরোধীদলীয় নেতার বাসায় রাষ্ট্রদূত, বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে উত্তাপ
2022.12.16
ঢাকা
মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস সম্প্রতি এক নিখোঁজ বিএনপি নেতার বাসায় যাবার পর নিরাপত্তা সংকটের প্রশ্নে দ্রুত স্থান ত্যাগ এবং সরকার ও দূতাবাসটির পাল্টাপাল্টি বিবৃতিতে দুই দেশের সম্পর্কে ভিন্ন ধরনের উত্তাপ পরিলক্ষিত হচ্ছে।
যদিও ঢাকায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বৃহস্পতিবার বলেছেন, এ ঘটনা যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের সম্পর্কের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না। তিনি আরও বলেন, ঘটনাটিকে নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই।
রাষ্ট্রদূত হাস গত ১৪ ডিসেম্বর এক দশক আগে নিখোঁজ হওয়া বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের মা ও বোনসহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে ঢাকায় তাঁদের বাসায় গিয়েছিলেন।
সুমনের বোন সানজিদা ইসলাম সেদিন বেনারকে জানান, এসময় সরকার সমর্থিত একটি গ্রুপ বাসার সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করলে নিরাপত্তার কারণে রাষ্ট্রদূত দ্রুত ফিরে যান। ‘গুমের’ শিকার হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের নিয়ে গঠিত সংগঠন ‘মায়ের ডাক’-এর সমন্বয়কারী সানজিদা।
সানজিদার বাসার সামনে ‘মায়ের কান্না’ নামে সংগঠনের ব্যানারে জড়ো হওয়া ওই লোকজন ১৯৭৭ সালে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনের সময় নিহত বা গুম হওয়া সেনা সদস্যদের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের উদ্বেগ প্রকাশের দাবি জানান।
ওই ঘটনায় সরকারের বেশ কয়েকজন মন্ত্রী, আওয়ামী লীগপন্থী বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এবং সরকার সমর্থক পেশাজীবীরা রাষ্ট্রদূতের সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠেন। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবসে স্মৃতি সৌধে না গিয়ে একজন বিরোধী নেতার বাসায় যাওয়ার জন্য পিটারের সমালোচনা করেন।
৫১ বছর আগের ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনা বাহিনী বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষের নেতৃস্থানীয় পেশাজীবীদের গণহারে হত্যা করেছিল।
‘সবার কথা শোনা গুরুত্বপূর্ণ’
সুমনের বাসায় বৈঠক সংক্ষিপ্ত করে ফেরার পর সফর নিয়ে সৃষ্ট ঘটনায় পিটার হাস পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনের সঙ্গে দেখা করে অভিযোগ করেছেন।
এ ছাড়া ঢাকায় ইউএস দূতাবাসের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে ১৫ ডিসেম্বর বলা হয়েছে, “গুমের ঘটনায় বেঁচে থাকা সবার কথা শোনা গুরুত্বপূর্ণ– তাঁদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা যাই হোক না কেন।”
দূতাবাসের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে, “যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে মানবাধিকার। রাষ্ট্রদূত হাস কথিত গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’ এর সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেছেন তাঁদের কাহিনী শুনতে এবং তাঁদের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে। তাঁদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা যাই হোক না কেন, বেঁচে থাকা সমস্ত লোকের কথা শোনার জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ।”
বুধবার সকালে ওই ঘটনার পর বিকেলে ঢাকার আমেরিকান সেন্টারে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র জেফ রাইডেনাওয়ার সাংবাদিকদের জানান, “নিরাপত্তাজনিত কারণে রাষ্ট্রদূত পিটার হাস সেখান থেকে দ্রুত চলে এসেছিলেন। এ বিষয়টি দূতাবাসের পক্ষ থেকে সরকারের উচ্চপর্যায়ে জানানো হয়েছে।”
ওই দিন সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূত জরুরি ভিত্তিতে তাঁর সঙ্গে দেখা করে বলেছেন যে তিনি একটি বাড়িতে গিয়েছিলেন, তাঁর ফেরার সময় বাড়ির বাইরে অনেক লোক ছিল এবং তাঁরা রাষ্ট্রদূতের সাথে কথা বলতে চেয়েছিল।
“তাঁর গাড়ি আটকানোর ভয় আছে জানিয়ে নিরাপত্তা কর্মীরা তাঁকে অবিলম্বে বাড়িটি ত্যাগ করে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তাই নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণে হাস দ্রুত বাড়ি ছেড়ে চলে যান এবং এতে তিনি খুব অসন্তুষ্ট,” মোমেন বলেন।
একই দিন ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপি নেতার বাড়িতে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সফরের কড়া সমালোচনা করে বলেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূত শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ পরিদর্শন করলে ভালো হতো।
ঘটনার একদিন পর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, “মায়ের কান্না”র (১৯৭৭ সালের কোর্ট মার্শালে নিহতদের পরিবারের সংগঠন) স্মারকলিপি গ্রহণ করলে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকতেন।”
অন্যদিকে বৃহস্পতিবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত দপ্তর সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স অভিযোগ করেন, পিটার হাসকে ভয় দেখানোর সঙ্গে সরকার জড়িত আছে।
তিনি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে এই ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তারা যে ভাষায় কথা বলেছেন তাতে বোঝা যায় সরকার তথা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এর সঙ্গে জড়িত ছিল।”
আওয়ামী লীগ সমর্থক বুদ্ধিজীবী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি দলও হাসের সমালোচনা করে বিবৃতি দিয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ প্রায় সব পেশাজীবী সংগঠনই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতিকেন্দ্রিক দুই শিবিরে বিভক্ত।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিজাত নিরাপত্তা বাহিনী র্যাব ও এর সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্র সরকার যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল, তার মূল কারণও ছিল বাংলাদেশে গুমের ঘটনাগুলো। ওই নিষেধাজ্ঞার পর থেকে সরকারের মন্ত্রী ও নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের কড়া সমালোচনা করে আসছেন, যা ১৪ ডিসেম্বরের ঘটনার পর আরও বেড়েছে।