২০-দলীয় জোট নিষ্ক্রিয় করে সরকার বিরোধী আন্দোলনে বিএনপির নতুন কৌশল

কামরান রেজা চৌধুরী
2022.12.23
ঢাকা
২০-দলীয় জোট নিষ্ক্রিয় করে সরকার বিরোধী আন্দোলনে বিএনপির নতুন কৌশল রাজশাহীর বিভাগীয় সমাবেশে বিএনপির নির্বাচনী প্রতীক ধানের শীষ হাতে কয়েকজন সমর্থক। ৩ ডিসেম্বর ২০২২।
[বেনারনিউজ]

এক দশক ধরে ২০-দলীয় ঐক্যজোটের মাধ্যমে সরকারবিরোধী আন্দোলন করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে সরাতে না পেরে এবার ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছে প্রধান বিরোধীদল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)।

আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন পরিকল্পনার অংশ হিসাবে ২০-দলীয় জোটকে ভেঙে দিয়েছে দলটি। বিএনপির নেতারা বলছেন, জোট ভেঙে দেয়ার অর্থ দুর্বলতা নয় বরং এর ফলে নতুন নতুন দল ও জোট বিএনপির ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ সংক্রান্ত ২৭-দফার আলোকে রাস্তায় যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তুলবে।

বিএনপি-জামায়াত জোট থেকে জামায়াত আলাদা হয়ে যাওয়ার কারণে অন্যান্য বাম সংগঠন বিএনপির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে সরকার বিরোধী আন্দোলনে শরিক হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।

বৃহস্পতিবার সাবেক ২০-দলীয় জোটের অন্তর্ভুক্ত নতুন ১২-দলীয় জোট আত্মপ্রকাশ করেছে। এই জোটে রয়েছে জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর), বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় দল, বাংলাদেশ এলডিপি (সেলিম), জাতীয় গণতান্ত্রিক দল, এনডিপি, মুসলিম লীগ (বিএমএল), জমিয়াতে উলামায়ে ইসলাম, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ ইসলামি পার্টি, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (নুরুল ইসলাম)।

জাতীয় প্রেসক্লাবে জোটের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠান শেষে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির প্রধান মেজর জেনারেল (অব) সৈয়দ মোহাম্মদ ইব্রাহিম বেনারকে বলেন, “আমরা আজকে ১২-দলীয় জোট ঘোষণা করেছি। এই জোট বিএনপির সাথে যুগপৎ সরকার বিরোধী আন্দোলন করবে।”

তিনি বলেন, “আমরা বিএনপির দাবির সাথে একাত্মতা ঘোষণা করছি। বিএনপি ও জামায়াত আলাদা আন্দোলন করবে এবং ১২-দলীয় জোট তাদের সাথে যুগপৎ আন্দোলন করবে। অন্যান্য সমমনা জোটও আমাদের সাথে যুগপৎ আন্দোলন করবে।”

বিএনপি, জামায়াত এবং কর্নেল অলি আহমেদের লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) আলাদাভাবে যুগপৎ আন্দোলন করার কথা জানিয়েছে।

সবার মত নিয়েই ২০-দলীয় জোট ‘নিষ্ক্রিয়’

বিএনপির মিডিয়া সেলের প্রধান জহির উদ্দিন স্বপন বেনারকে বলেন, “সকল দলের মতামতের ভিত্তিতেই ২০-দলীয় জোটকে নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। উদ্দেশ্য হলো এই সরকারের বিরুদ্ধে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলা।”

তিনি বলেন, “বিএনপি, জামায়াত, এলডিপি, ১২-দলীয় জোট সবাই আলাদা হলেও যুগপৎভাবে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করবে। আমাদের দেয়া রাষ্ট্র সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করে দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা হবে।”

তিনি বলেন, “শুধু ১২-দলীয় জোট নয়। ৭-দলীয় গণতন্ত্র মঞ্চ আমাদের সাথে রয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য দলের সাথেও আলোচনা চলছে। এই সরকারের বিরুদ্ধে সকল গণতান্ত্রিক শক্তি ঐক্যবদ্ধ হবে। দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে।”

‘এখন জামায়াতের রাজনৈতিক দায় বিএনপি নেবে না’

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলার পর বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন জমাতে দেশের বিভিন্ন ছোট ছোট দল নিয়ে ২০০৫ সালের শুরুর দিকে ১৪-দলীয় জোট গঠন করে আওয়ামী লীগ। এই দলগুলোর অধিকাংশরই তেমন জনসমর্থন নেই।

১৪-দলীয় জোটের সদস্যরা ২০০৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতীক নৌকা নিয়ে নির্বাচন করে জয়ী হন এবং নির্বাচন না করেও সাম্যবাদী দলের প্রধান দিলীপ বড়ুয়া শিল্পমন্ত্রী হন।

একই কায়দায় ২০০৯ সালে নির্বাচনে পরাজিত হয়ে বিভিন্ন ছোট ছোট দল নিয়ে বিএনপির নেতৃত্বে গঠিত হয় ২০-দলীয় জোট। বিএনপির নেতৃত্বাধীন এই জোট ২০১৪ ও ২০১৫ সালে সহিংস আন্দোলন করে ব্যর্থ হয়।

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর ২০-দলীয় জোটের ব্যানারে নির্বাচন করে পরাজিত হয় জোট। বিএনপি বলছে, ভোটের আগের রাতে ব্যালট বাকশো ভরিয়ে তাদের পরাজিত করা হয়েছে। তবে আওয়ামী লীগ সেই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।

“বিএনপি যেসব দল নিয়ে জোট গঠন করছে এদের নাম দেশের মানুষ জানে না,” মন্তব্য করে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শাজাহান খান বেনারকে বলেন, “২০০৫-০৬ সাল এবং ২০২২ সালের মধ্যে অনেক পার্থক্য। তারা পুরানো কৌশলে খেলছে। এতে লাভ হবে না। আওয়ামী লীগ তার সাংগঠনিক শক্তি দিয়েই বিএনপি-জামায়াত জোটকে মোকাবিলা করবে।”

নতুন যে ১২-দলীয় জোট আত্মপ্রকাশ করেছে সেটি রাস্তার আন্দোলনে বড়ো ভূমিকা রাখতে পারবে বলে মনে করেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নিজাম উদ্দিন আহমেদ।

তিনি বলেন, “এই দলগুলো বিএনপির নেতৃত্বে ২০-দলীয় জোটে ছিল এবং বিএনপির রাজনৈতিক কৌশল হিসাবে ২০-দলীয় জোট ভেঙে দিয়ে তাদের ১২-দলীয় জোট গঠনের পরামর্শ দেয়া হয়েছে।”

“পুরো ২০-দলীয় জোটের মধ্যে বিএনপি এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ছাড়া অন্য দলের অবস্থান নেই। এদের কোনো লোকজনও নেই যে আন্দোলন করবে। এরা থাকা বা না থাকার তেমন পার্থক্য নেই,” বলেন অধ্যাপক নিজাম।

নতুন জোট গঠনে বিএনপির দুইটি উদ্দেশ্য রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

“প্রথমত: বিএনপি বলতে পারবে যে তাদের সঙ্গে এতোগুলো রাজনৈতিক দল ও জোট রয়েছে যারা তাদের ২৭-দফা দাবির সাথে একমত। দ্বিতীয়ত: বিএনপি বলতে পারবে যে, তারা জামায়াতের সাথে রাজনৈতিক আন্দোলনে নেই,” বলেন তিনি।

জামায়াতের সাথে ২০-দলীয় জোটে থাকার কারণে আওয়ামী লীগ সব সময়ই বিএনপি-জামায়াত এক করে তাদের স্বাধীনতা বিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করে জানিয়ে তিনি বলেন, “২০-দলীয় জোট ভেঙে দেয়ার ফলে এখন জামায়াতের রাজনৈতিক দায় বিএনপি নেবে না।”

বিএনপির নেতৃবৃন্দ এবং সমর্থকদের একটি বিরাট অংশ জামায়াতের স্বাধীনতা বিরোধী ভূমিকার দায় নিতে চায় না বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, “তবে, দলের তৃণমূল নেতা, সমর্থক এবং ভোটাররা যতই জামায়াত বিরোধী হোক না কেন, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব জামায়াতের পক্ষে। সেকারণে, দিন শেষে কাগজে-কলমে আলাদা থাকলেও বিএনপি-জামায়াত একত্রিত থাকবে।”

“জামায়াতের নিবন্ধন না থাকলে আগামী নির্বাচনে হয়তো দলটির অনেক নেতাই বিএনপির মনোনয়নে ভোট করবেন এবং আওয়ামী লীগ এগুলো ভোটের মাঠে ব্যবহার করবে,” যোগ করেন তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।