দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থী সমর্থকদের সহিংসতা সংঘাতময় করে তুলছে নির্বাচন
2023.12.26
ঢাকা
প্রধান বিরোধীদল অনুপস্থিতি থাকলেও সংসদ নির্বাচনের দিন যতই এগিয়ে আসছে, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে সংঘাত, সংঘর্ষের ঘটনা ততই বেড়ে চলছে।
গত দুই সপ্তায় ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে সহিংসতার ঘটনায় কমপক্ষে তিন জনের মৃত্যু ছাড়াও আহত হয়েছেন দুই শতাধিক। পুলিশ, প্রার্থী এবং স্থানীয় গণমাধ্যম সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব সহিংসতায় আক্রান্ত হচ্ছেন স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। এখন পর্যন্ত সহিংসতায় নিহত তিনজনই স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থক।
নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচার গত ১৮ ডিসেম্বর থেকে শুরু হলেও ১৫ নভেম্বর তফসিল ঘোষণার পর থেকেই নিজেদের মধ্যে সংঘাত-সহিংসতায় জড়িয়ে পড়েন সরকারি দলের সমর্থকেরা।
দুই সপ্তায় নিহত তিন
পিরোজপুর-১ সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী শ ম রেজাউল করিম ও দলটির স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম এ আউয়ালের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় আহত হয়ে ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১২ ডিসেম্বর মারা যান স্বতন্ত্র প্রার্থী আউয়ালের সমর্থক লালন ফকির (২৭)।
এই ঘটনায় প্রতিপক্ষ রেজাউল করিমকে দায়ী করলেও অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বর্তমান সংসদ সদস্য এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী রেজাউল।
এরপর ১৯ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ সদর উপজেলায় আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. আমিনুল হকের নির্বাচনের প্রচারকেন্দ্র স্থাপন করা নিয়ে বিরোধের জেরে মারধরের শিকার হয়ে রফিকুল ইসলাম (৫২) নামের এক ব্যক্তি নিহত হন।
পুলিশ ঘটনাটিকে পারিবারিক বিরোধ হিসেবে দাবি করলেও স্থানীয় সিরতা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু সাঈদ বেনারকে বলেন, প্রার্থীর জন্য একটি প্রচারকেন্দ্র বানাতে গিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে মারা যান রফিকুল।
সর্বশেষ গত ২৩ ডিসেম্বর মাদারীপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আবদুস সোবহান মিয়ার সমর্থকরা দলটির স্বতন্ত্র প্রার্থী তাহমিনা বেগমের সমর্থক এসকেন্দার খাঁ (৭০) নামে এক ব্যক্তিকে কুপিয়ে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এ প্রসঙ্গে তাহমিনা বেনারকে বলেন, “তিনি (এসকেন্দার) আমার বিরুদ্ধে কাজ করতে রাজি না হওয়ায় তাঁকে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।”
তবে এসকেন্দার খাঁর ওপর হামলার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সোবহান মিয়া। তিনি বেনারকে বলেন, “পূর্ব শত্রুতার কারণে এসকেন্দার খুন হয়ে থাকতে পারেন। এখানে নির্বাচনের কোনো বিষয় নেই।”
এই ঘটনায় পুলিশ সোমবার ভোররাতে ঢাকা থেকে একজনকে গ্রেপ্তার করে।
মঙ্গলবার বিকেলে নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার মাসুদ আলম বলেন, “দীর্ঘদিন এলাকার কোন্দলের পাশাপাশি স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থক হওয়ায় এসকেন্দার খাঁকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।”
অর্ধশত সংঘর্ষ, আহত প্রায় ২০০
নির্বাচনের ১২দিন বাকি থাকলেও প্রায় প্রতিদিনই একের পর এক সহিংসতার ঘটনা ঘটছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়।
নির্বাচন কমিশন, পুলিশ ও প্রার্থীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোর বরাতে জানা গেছে, ১৫ নভেম্বর তফসিল ঘোষণার পর মঙ্গলবার পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় কমপক্ষে ৫০টি সংঘর্ষের ঘটনায় প্রায় ২০০ জন আহত হয়েছেন।
স্বতন্ত্র প্রার্থী ও আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যেই সংঘর্ষের ঘটনা বেশি হচ্ছে। নির্বাচনী প্রচার ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও প্রতিপক্ষকে মারধরের পাশাপাশি বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন এবং গোলাগুলির কয়েকটি ঘটনাও ঘটছে।
মঙ্গলবার বিকেলে রংপুর-৫ আসনে ট্রাক মার্কা নিয়ে নির্বাচনী লড়াইয়ে থাকা আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী জাকির হোসেন সরকারের সমর্থকদের ওপর নৌকার প্রার্থী রাশেক রহমানের সমর্থকরা হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এই ঘটনায় কমপক্ষে ১০ জন আহত হয়েছেন
জাকির হোসেন সরকার সাংবাদিকদের বলেন, “আমার সমর্থকরা প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। এসময় নৌকার লোকজন তাদের ওপর হামলা চালিয়ে ১০ জনকে আহত করেছে। আমরা ঘটনাস্থলে এসে এর প্রতিবাদ করেছি।”
এ বিষয়ে নৌকার রাশেক রহমানের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
মিঠাপুকুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নজরুল ইসলাম বলেন, ঘটনাস্থলে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।
গত সোমবার রাতে দেশের কয়েকটি এলাকায় আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও দলটির স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
নির্বাচনে বিরোধীদল না থাকলেও সংঘাত-সহিংসতা প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বেনারকে বলেন, “বিরোধী দলহীন নির্বাচনে গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে শতাধিক ব্যক্তি নিহত হয়েছিলেন, যাদের অধিকাংশই ছিল আওয়ামী লীগের।”
“সংসদ সদস্য হতে পারলেই ক্ষমতা আর টাকা—এমন এক পরিস্থিতিতে কে এই টাকা আর ক্ষমতার মালিক হবেন সেই লড়াই প্রাণঘাতি হয়ে যাচ্ছে,” বলেন তিনি।
পরিস্থিতি শান্ত হয়ে যাবে: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
প্রার্থীদের মধ্যে সংঘাত সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়া প্রসঙ্গে মঙ্গলবার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি এবং সশস্ত্রবাহিনী মাঠে নামলে ভোটের পরিবেশ আরও শান্ত ও সুন্দর হবে।
সারাদেশে নির্বাচন ঘিরে সহিংসতা হচ্ছে এবং পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে-এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, “নির্বাচন কমিশন সবসময় মনিটর করছে। যাকে মনে করছে বদলাতে হবে, আমাদের কাছে লিস্ট পাঠাচ্ছে, তাৎক্ষণিক তাকে পাল্টে দেওয়া হচ্ছে।”
তিনি বলেন, আগামী ২৯ ডিসেম্বর মাঠে বিজিবি থাকবে, বিজিবির পর সশস্ত্র বাহিনী চলে আসবে ৩ জানুয়ারি থেকে।
“কাজেই যেসব বিষয়ে আপনারা আশঙ্কা করছেন, কিংবা যা দেখছেন সেই পরিস্থিতি আরও শান্ত হয়ে যাবে, আরও সুন্দর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে,” বলেন তিনি।
রাজনৈতিক সংঘাতে প্রাণ ঝরছেই
আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও অন্যান্য বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিরোধী দল অংশ নিচ্ছে না। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অধিকাংশ নেতাকে জেলে রেখেই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে নির্বাচন।
সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় আয়োজিত বিএনপির মহাসমাবেশে দলটি কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের বড়ো সংঘর্ষের পর দায়ের হওয়া মামলায় গ্রেপ্তার হন এসব নেতা।
ওই সংঘর্ষের দিন এক পুলিশ সদস্য ও একজন বিএনপি নেতা মারা যান।
পুলিশ ও বিএনপির তরফ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, ২৮ অক্টোবরের নিহত দুইজনসহ ওই দিনের পর থেকে রাজনৈতিক সহিংসতায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও পরিবহণ শ্রমিক মিলিয়ে কমপক্ষে ৩০ জনের মৃত্যু হয়েছে, যাদের মধ্যে সাতজন মারা গেছেন কারাগারে। নিহতদের কমপক্ষে ২৪ জন বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
এদিকে গত ১৫ নভেম্বর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর মারা যাওয়া বিএনপি নেতাকর্মীর সংখ্যা কমপক্ষে ১১জন।
“এই বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রাণহানির জন্য কিন্তু রাজনৈতিক নেতারাই দায়ী। আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান না করে নিজ নিজ অবস্থানে অনড় থাকার ফলেই এসব ঘটছে,” বলেন বদিউল আলম মজুমদার।