সংসদ নির্বাচন: ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বিরোধে কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার করছে ইসি

অয়ন আমান
2023.12.29
ঢাকা
সংসদ নির্বাচন: ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বিরোধে কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার করছে ইসি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দোকানে রাজনৈতিক প্ল্যাকার্ড সাজিয়ে রাখছেন এক দোকানি। ছবিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে তোলা‌। ২০ ডিসেম্বর ২০২৩।
[জীবন আহমেদ/বেনারনিউজ]

ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত এবং একই দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে চলমান নির্বাচনী বিরোধের মধ্যে নির্বাচন কমিশন (ইসি) একের পর এক সরকারি কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার করছে।

তফসিল ঘোষণার পর পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে প্রশাসন ও পুলিশের মাঠ পর্যায়ের অন্তত ২৫ জন কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে, সর্বশেষ বৃহস্পতিবার রাতে ফরিদপুরের তিন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, মূলত এই “একতরফা নির্বাচনে” সরকারি দলেরও প্রতিপক্ষও একই দলের নেতারা। এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষতা দেখাতে অভিযোগ আমলে নিয়ে কর্মকর্তাদের সরিয়ে দিচ্ছে, যা নিয়ে সহজেই প্রশ্ন তোলা যায়।

গত ১৮ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রচার শুরুর দিন থেকে বিভিন্ন অভিযোগে তিন জন জেলা প্রশাসক (ডিসি), ছয় জেলার পুলিশ সুপার (এসপি), দুই মহানগরীর পুলিশ কমিশনার, দুইজন উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা ও বারোটি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে প্রত্যাহারের আদেশ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।

এর আগে গত ৩০ নভেম্বর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিলিয়ে চার শতাধিক কর্মকর্তাকে বদলি করতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দিয়েছিল ইসি, যা ইতিমধ্যে কার্যকর হয়েছে।

এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীরা “একই দলের” হওয়ায় “এখানে তেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে না” মন্তব্য করে সরকারের সাবেক স্থানীয় সরকার সচিব আবু আলম মোহাম্মদ শহীদ খান বেনারকে বলেন, নির্বাচন কমিশন শুরুর দিকে বড়ো আকারের যে রদবদল করল, “সেটার দরকার ছিল বলে মনে হয় না।”

তাঁর মতে, “এই নির্বাচন তো প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন নয়। তারপরও এই নির্বাচনে বেশ কিছু সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে এবং একাধিক মৃত্যু হয়েছে। নির্বাচন কমিশন যেসব ব্যবস্থা নিয়েছে বা নিচ্ছে তা নিজেদের ভাবমূর্তি এবং মুখ রক্ষার জন্য।”

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদারের মতে, “নির্বাচনের মাত্র নয় দিন বাকি থাকতে জেলা প্রশাসক বদলির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে; কারণ তিনি রিটার্নিং কর্মকর্তাও। নির্বাচন পরিচালনার সামগ্রিক দায়িত্বে থাকেন তিনি। এই স্বল্প সময়ে জেলায় কর্মরত কর্মকর্তাদের চিনতেও তাঁর সমস্যা হবে।”

“নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত অন্য কর্মকর্তাদের বেলায়ও একই সমস্যা হতে পারে,” বেনারকে বলেন তিনি।

যদিও তিনি মনে করেন, কমিশনের বদলি বা পদায়নের ক্ষমতা আছে, আগেও এটা করা হয়েছে। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা।

কোনো পক্ষপাতমূলক আচরণের তথ্য-উপাত্ত নির্বাচন কমিশনের কাছে থাকলে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তা বদলি বা প্রত্যাহার করা যায় জানিয়ে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা বেনারকে বলেন, “সেই ক্ষমতা নির্বাচন কমিশন প্রয়োগ করছে।”

তবে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে প্রশাসনে কর্মকর্তাদের প্রত্যাহারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা জানিয়ে তিনি বলেন, “কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকলেও জাতীয় স্বার্থে প্রত্যাহার আদেশ মেনে নেওয়া উচিত। ...এখন বদলি বা প্রত্যাহারের শিকার হলেও বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে পরবর্তীতে অনেকের চাকরির ক্ষেত্রে তা প্রভাব ফেলবে বলে মনে হয় না।”

35192820-5d03-42aa-848b-b60e94701b3a.jpg
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী পোস্টারে ছেয়ে গেছে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকা। ঢাকার খিলগাঁও এলাকা থেকে তোলা ছবি। ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩। [মো: হাসান/বেনারনিউজ]

মাঠে দায়িত্ব পালন কঠিন’

প্রার্থিতা নিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তার পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিযোগে গত ১০ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক শাহগীর আলমকে প্রত্যাহার করে নির্বাচন কমিশন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ফিরোজুর রহমানের পক্ষে তাঁর ছেলে অভিযোগ দায়ের করার পর কমিশন এই সিদ্ধান্ত নেয়।

গত ২৪ ডিসেম্বর ফরিদপুর-৪ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ও দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ এক নির্বাচনী সভায় এসপির বিরুদ্ধে পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিযোগ করেন। পরদিন ২৫ ডিসেম্বর ফরিদপুর জেলার পুলিশ সুপার মো. শাহজাহানকে প্রত্যাহার করে ইসি।

সুনামগঞ্জ-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়া সেনগুপ্তা দিরাই থানার ওসি ইখতিয়ার উদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ করেন, এরপর তাঁকে প্রত্যাহার করে ইসি।

অধিকাংশ ওসির বিরুদ্ধেই পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিযোগ করেছেন সরকারদলীয় প্রতিপক্ষ প্রার্থীরা। গত বৃহস্পতিবার রাতে ফরিদপুর জেলায় তিন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়। অন্যান্য আদেশের মতো তাঁদের বদলি আদেশে বলা হয়, নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে বদলি করা হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে প্রত্যাহার হওয়া দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় এক থানার ওসি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, একজন সরকারি কর্মকর্তার জন্য এটি অসম্মানজনক হলেও তাঁদের কিছু করার নেই। এমনিতেই সরকারি দলের স্থানীয় নেতাদের চাপে মাঠে দায়িত্ব পালন করা কঠিন, তার ওপর নির্বাচনের সময় তা আরও কঠিন হয়ে পড়েছে।

তিনি বলেন, সরকারদলীয় নেতাদের মধ্যে এই নির্বাচন যুদ্ধের সময় দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ায় তিনি বরং খুশি। তবে তিনি মনে করেন, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ মাঠের পরিস্থিতি বুঝলেও নির্বাচন কমিশন বুঝতে চায়নি।

সকল প্রার্থী সমান’

নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান বেনারকে বলেন, “আমাদের কাছে সকল প্রার্থী সমান। নিরপেক্ষতার সাথে বিচার-বিশ্লেষণ করে কিছু তথ্য প্রমাণ পাওয়ার পরেই বিভিন্ন উৎস থেকে যখন আমরা প্রতিবেদন নিয়েছি সেই প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই ব্যবস্থা নিয়েছি।”

কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগগুলো “যাচাই-বাছাই করে” ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “কোনো জায়গায় নিরপেক্ষতাহীনতার সামান্যতম ঘটনা ঘটেনি। এখানে আমরা কারো পক্ষ নই বা কারো প্রতিপক্ষ নই।”

তিনি আরও বলেন, “আমরা নিরপেক্ষতার সাথে কাজ করে যাচ্ছি সুষ্ঠু নির্বাচন করার জন্য। কে কোন দলের না স্বতন্ত্র সেটাও বিবেচ্য নয়। বিবেচ্য হচ্ছে সে প্রার্থী। সকল প্রার্থীকে সমান সুযোগ দিতে হবে। যদি কোথাও কোনো কর্মকর্তা শৈথিল্য দেখান তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আমরা একটুও কুণ্ঠিত নই, দ্বিধান্বিত নই।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।