আদালতের নির্দেশে সাড়ে চার বছর পর বুয়েটে আবার চালু হচ্ছে ছাত্র রাজনীতি
2024.04.01
ঢাকা
ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের দাবি অনুযায়ী প্রায় সাড়ে চার বছর বন্ধ থাকার পর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ছাত্র রাজনীতি চালুর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তবে সেটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে নয়, আদালতের নির্দেশে।
সোমবার হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ ছাত্র রাজনীতির ওপর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা স্থগিত করে। প্রশাসন আদালতের এই রায় মানতে বাধ্য বলে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য সত্য প্রসাদ মজুমদার।
ছাত্র রাজনীতির বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা গত সপ্তাহ থেকে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করে আসছেন। ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত স্থগিত করে দেয়া আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়ায় লড়তে উপাচার্যের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা।
সোমবার দুপুরে আদালতের আদেশের পর বিকেলে বুয়েটের সংবাদ সম্মেলন করে এ আহ্বান করেন তাঁরা। তিন জন শিক্ষার্থী সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনালেও তাঁরা নিজেদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করেননি। বুয়েটের সব শিক্ষক ও অ্যালামনাইদের ছাত্ররাজনীতি বন্ধ রাখার পক্ষে অবস্থান নিয়ে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার অনুরোধ জানান তাঁরা।
“যে ছাত্ররাজনীতি র্যাগিং কালচারকে প্রশ্রয় দেয়, ক্ষমতার অপব্যবহারের পথ খুলে দেয়, যার বলি হতে হয় নিরীহ ছাত্রদেরকে, তা আমাদের জন্য ভালো কিছু কখনোই বয়ে আনেনি, আনবেও না। এর চরমতম মূল্য হিসেবে আমরা আমাদের কেমিকৌশল ৯৯ এর সাবেকুন্নাহার সনি আপু, যন্ত্রকৌশল ০৯ এর আরিফ রায়হান দ্বীপ ভাই এবং সর্বশেষ তড়িৎকৌশল ১৭ এর আবরার ফাহাদ ভাইকে হারিয়েছি,” বলা হয় সংবাদ সম্মেলনে।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের অক্টোবরে ফেসবুকে ভারতকে কটাক্ষ করে একটি পোস্ট দেওয়ার ঘটনায় বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করেন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে এবং ছাত্র-শিক্ষক সবার সম্মতিতে ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে বুয়েট প্রশাসন। ওই ঘটনায় বুয়েটের ২০ শিক্ষার্থীকে মৃত্যুদণ্ড এবং ৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় আদালত।
যেভাবে ঘটনার সূত্রপাত
অনেকটা হঠাৎ করেই বুয়েটে ছাত্র রাজনীতির বিষয়টি সামনে চলে আসে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ২৭ মার্চ মধ্যরাতে ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেনসহ সংগঠনের কয়েকজন নেতা-কর্মী বুয়েটের কয়েকজন ছাত্রসহ ক্যাম্পাসে ঢুকে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
এই ঘটনার প্রতিবাদে ২৯ মার্চ সাধারণ শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ সমাবেশ করেন এবং বুয়েটে ছাত্রলীগের নেতা ইমতিয়াজ হোসেনকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সংগঠক হিসাবে চিহ্নিত করে তাঁর আবাসিক সিট বাতিল করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
তবে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ইমতিয়াজকে স্থায়ী বহিষ্কার এবং বুয়েটে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধসহ অন্যান্য দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।
গত রোববার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক প্রতিবাদ সমাবেশ করে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি পুনরায় চালু করতে ২৪ ঘণ্টার পাল্টা আল্টিমেটাম দেয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেন, দাবি আদায়ে প্রয়োজনে আদালতে যাবেন।
ছাত্রলীগ নেতারা বলছেন, রাজনীতি করতে না দেয়া সাংবিধানিক অধিকারের পরিপন্থী। ছাত্রলীগের অভিযোগ বুয়েটে হিযবুত তাহরির, ছাত্র শিবিরসহ বিভিন্ন উগ্রবাদী ছাত্র সংগঠন জঙ্গি কার্যক্রম চালিয়ে আসছে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ রাখার ঘোষণার সমালোচনা করে বলেন, রাজনীতি করলে বুয়েটে যাওয়া যাবে না—এমন অবস্থান সঠিক নয়।
“আমরা পরিষ্কার একটা কথা বলতে চাই, ঘটনার তদন্ত চলছে। আমরা খতিয়ে দেখছি। ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার নামে বুয়েটকে একটা অপরাজনীতি-জঙ্গিবাদের কারখানায় রূপান্তরিত করা হবে, পরিণত করা হবে—এটা যাতে না হয়। আমরা তদন্ত করে দেখছি, এ ধরনের কিছু পাওয়া গেলে সরকারকে অ্যাকশনে যেতে হবে,” বলেন তিনি।
সকালে রিট, দুপুরে আদেশ
সোমবার সকালে ২০১৯ সালের ১১ অক্টোবর বুয়েট প্রশাসনের জারি করা ছাত্র রাজনীতি বন্ধ সংক্রান্ত আদেশের বিরুদ্ধে রিট দায়ের করেন বুয়েটের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ নেতা ইমতিয়াজ হোসেন।
রিটের ওপর প্রাথমিক শুনানি শেষে সোমবার দুপুরে বুয়েটের ওই আদেশের কার্যকারিতা স্থগিত করেন বিচারপতি মো. খসরুজ্জামান ও বিচারপতি কে. এম. জাহিদ হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ। বিষয়টি সাংবাদিকদের কাছে নিশ্চিত করেন রিটকারীর আইনজীবী আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক।
তিনি বলেন, “আদালতের এই আদেশের ফলে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতির ওপর আর কোনো বাধা থাকল না।”
আদালতের রায়ের পর সোমবার এক প্রতিক্রিয়ায় বুয়েটের উপাচার্য সাংবাদিকদের জানান, আদালতের রায় মানতে বাধ্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
তবে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের একজন রাফি (নিরাপত্তার কারণে নাম পরিবর্তিত) সোমবার বেনারকে বলেন, “আমাদের আন্দোলন ছাত্রলীগ বিরুদ্ধে নয়। আমরা লেখাপড়া করতে চাই। খুনোখুনি নয়। এই রাজনীতি ছাত্রদের অধিকার নিয়ে কথা বলে না। সে কারণেই ছাত্র রাজনীতির বিরোধিতা। ”
“আর বুয়েটে যদি জঙ্গি থাকে তাহলে সরকারের বিভিন্ন এজেন্সি আছে তারা তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে পারে। ছাত্র রাজনীতির জন্য পুরো বুয়েটকে জঙ্গি বানানো কি ঠিক?,” যোগ করেন তিনি।
‘আন্দোলন ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে নয়’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ আনু মুহাম্মদ সোমবার বেনারকে বলেন, বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির বড়ো সমস্যা হলো, ক্ষমতাসীন দলগুলো সবাই তার ছাত্র সংগঠনটিকে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে। তাদের গুণ্ডামি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্ন কাজে পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়। সেকারণেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ে।
তিনি বলেন, “বুয়েটের শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলন করছে সেটি ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে নয়। ২০১৯ সালে ছাত্রলীগের হাতে শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যা এবং এই হত্যার সাথে যুক্ত বুয়েট শিক্ষার্থীদের সাজা হওয়ার পর সেখানকার শিক্ষার্থীরা মনে করে ছাত্র রাজনীতি থাকলে এভাবে খুনোখুনি চলবে। শিক্ষার পরিবেশ ব্যাহত হবে। সে কারণে তাঁরা ছাত্র রাজনীতি চান না।”
তিনি বলেন, “রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে বুয়েটকে জঙ্গিবাদে যুক্ত করা যুক্তিযুক্ত নয়।”
“ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক বললেন, বুয়েটে জঙ্গিবাদ সৃষ্টি হচ্ছে কি না তা দেখবেন,” উল্লেখ করে তিনি বলেন, “কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া এই ধরনের কথা আসলে একটি খারাপ সংস্কৃতির অংশ।”
বুয়েটের সাবেক শিক্ষার্থী এবং স্থপতি আবু মুসা ইফতেখার সোমবার বেনারকে বলেন, বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি চালু থাকার সময় সেখানকার পরিবেশ ছিল অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ। ছাত্র সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ভোট চাইতেন এবং তখনকার দ্বন্দ্বটি ছিল আদর্শিক। সেখানে কোনো পেশিশক্তির ব্যবহার ছিল না বলা যায়।
তিনি বলেন, বিএনপি আমলে সবিকুন্নাহার সনি হত্যার পর বুয়েটের রাজনীতিতে পেশিশক্তির ব্যবহার শুরু হয়, যা দুঃখজনক।
বুয়েটে সর্বশেষ ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছে ২০ বছর আগে জানিয়ে তিনি বলেন, “বর্তমানে সেখানে রাজনীতি নেই। রাজনীতি না থাকলে সেখানে তো জঙ্গিবাদ সৃষ্টি হতেই পারে। হয়তো এর মাত্রা খুবই কম। জঙ্গিবাদ শুধু কি ইসলামী জঙ্গিবাদ? বুয়েটে যেভাবে হিন্দু শিক্ষার্থীদের আলাদা করে রাখা হয়, সেখানে উগ্র হিন্দুত্ববাদ জন্ম নিলেও আমি অবাক হবো না।”
“কোনো দেশে শ্রমিক-কর্মচারী সংকট দেখা দিলে বাইরের দেশ থেকে এনে সেটি পূরণ করা সম্ভব। কিন্তু দেশে রাজনীতিবিদ না থাকলে বাইরে থেকে রাজনীতিবিদ নিয়ে এসে বাংলাদেশ পরিচালনা করা সম্ভব নয়। সেকারণেই বুয়েটে সুস্থ ধারার রাজনীতি চর্চা করা দরকার,” যোগ করেন তিনি।