বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের জন্য সংলাপ চায় মার্কিন প্রতিনিধিদল

আহম্মদ ফয়েজ
2023.10.15
ঢাকা
বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের জন্য সংলাপ চায় মার্কিন প্রতিনিধিদল ঢাকার হোটেল শেরাটনে বৈঠকের ফাঁকে মার্কিন প্রতিনিধি দলের সদস্য ও এনডিআই’র এশিয়া-প্যাসিফিকের রিজিওনাল ডিরেক্টর মনপ্রীত সিং আনন্দের সঙ্গে কথা বলছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। ৯ অক্টোবর ২০২৩।
[সাবরিনা ইয়াসমীন/বেনারনিউজ]

বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক, বিশ্বাসযোগ্য ও সহিংসতামুক্ত করতে রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল।

রোববার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, শর্তযুক্ত কোনো সংলাপ করবে না আওয়ামী লীগ, বিএনপি শর্ত বাদ দিলে সংলাপ বিবেচনা করা হতে পারে। 

গত ৮ থেকে ১১ অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকায় সফরকালে প্রধানমন্ত্রী, নির্বাচন কমিশন (ইসি), আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং অন্যান্য অংশীজনের সঙ্গে বৈঠক করেন পর্যবেক্ষক দলের সদস্যরা।

এরপর বিবৃতিতে সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট (এনডিআই) ও ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের (আইআরআই) সমন্বয়ে গঠিত পর্যবেক্ষক দলটি।

যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় শনিবার রাতে ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিবৃতিতে পাঁচটি সুপারিশ করা হয়েছে।

প্রতিনিধি দলের পাঁচ সুপারিশ

পাঁচ দিনের মিশন শেষে মার্কিন প্রতিনিধি দলটি বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সরকার, রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশন ও অংশীজনের কাছে পাঁচটি সুপারিশ রেখেছে।

বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে পারে এমন বিশ্বাসযোগ্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক, অংশগ্রহণমূলক ও অহিংস নির্বাচনের দিকে অগ্রগতির জন্য একটি রোডম্যাপ হিসেবে এই পাঁচ দফা সুপারিশ করা হয়েছে।

প্রথমেই নির্বাচন ইস্যুতে মুক্ত ও খোলামেলা সংলাপের আয়োজনের সুপারিশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত জনসমক্ষে তাদের বক্তৃতা সংযত করা এবং বিদ্যমান আচরণবিধি মেনে অপরাপর রাজনৈতিক শক্তিগুলোর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া।

সংলাপের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার সমাধানে একটি পথ খুঁজে পেতে এবং বাস্তব, দীর্ঘস্থায়ী ও বিশ্বাসযোগ্য পরিবর্তনের জন্য দলগুলোকে একে অন্যের প্রতি বিশ্বাস রেখে আলোচনায় বসতে হবে।

দ্বিতীয় সুপারিশ হলো, মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা এবং একটি মুক্ত নাগরিক পরিবেশ রাখতে হবে, যেখানে ভিন্ন মতকে সম্মান করা হয়। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজসহ অন্যান্য অংশীজনের স্বাধীনতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে বিবৃতিতে।

তৃতীয় সুপারিশে বলা হয়েছে, সহিংসতামুক্ত নির্বাচনের অঙ্গীকার নিশ্চিত করা এবং রাজনৈতিক সহিংসতায় জড়িতদের জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসা।

বিবৃতিতে রাজনৈতিক দল ও দলীয় নেতা-কর্মীদের আচরণের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

চতুর্থ সুপারিশ হলো, স্বাধীন নির্বাচন ব্যবস্থাপনাসহ সব দলের অর্থপূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার পরিস্থিতি তৈরি করা। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক নিরপেক্ষতার ওপর জোর দেওয়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোকে অহিংসা ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কার্যকলাপে জড়িত থাকার বিশ্বাসযোগ্য অভিপ্রায় প্রদর্শনের তাগিদ দেওয়া হয়েছে বিবৃতিতে।

পঞ্চম ও শেষ সুপারিশ করা হয়েছে—নাগরিকদের মধ্যে সক্রিয় ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনে অংশগ্রহণের সংস্কৃতি তৈরি করতে হবে এবং তা এগিয়ে নিতে হবে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সব অংশীজনকে অহিংসা, সংযম এবং সম্মতিমূলক রাজনীতির নির্বাচনী পরিবেশে অবদান রাখতে হবে, যা বৈষম্য ছাড়াই নির্বাচনে সব নাগরিকের অংশগ্রহণে সহায়ক হবে। 

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের রীতি, গতিশীল গণমাধ্যম, সক্রিয় নাগরিক সমাজ ও সক্রিয় রাজনৈতিক তৎপরতা থাকার পরও বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক যাত্রা বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে।

নির্বাচনের প্রাক-পরিবেশ মূল্যায়নে সংক্রান্ত ছয় সদস্যের ওই প্রতিনিধি দলের প্রধান বনি গ্লিক বিবৃতিতে বলেন, “আমরা মনে করি, এই সুপারিশগুলো পালন করলে সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে এবং এটি নির্বাচন প্রক্রিয়াটিকে উন্নত করতে সাহায্য করতে পারে।”

“প্রাথমিক সমস্যা হলো প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গঠনমূলক আলোচনা বা সম্পর্কের অভাব,” বলেন প্রতিনিধি দলের আরেক সদস্য কার্ল ইন্ডারফুর্থ।

তিনি বলেন, “এই অচলাবস্থার অবসানের সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচনের জন্য এবং তার পরেও সুসম্পর্কের জন্য সংলাপের আয়োজন করা।”

68e53168-1ddf-46f9-b014-193fe020d866.jpg
ঢাকার গুলশান কার্যালয়ে বিএনপি নেতাদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলের বৈঠক। ৯ অক্টোবর ২০২৩। [সাবরিনা ইয়াসমীন/ বেনারনিউজ]

অনড় আওয়ামী লীগ-বিএনপি

চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে সংলাপের প্রতি দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহল থেকে গুরুত্বারোপ করা হলেও নিজ নিজ রাজনৈতিক অবস্থানে অনড় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপি।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান বেনারকে বলেন, “সংলাপ আমাদের এখানে আগেও অনেক হয়েছে কিন্তু কোনো সংলাপই ফলপ্রসূ হয়নি। ফলে সমস্যার যেমন সমাধান হয়নি, তেমনি মানুষের মধ্যে সংলাপ নিয়ে হতাশা বেড়েছে।”

তিনি আরও বলেন, “আমরা মনে করি, আমাদের সব সংকটের সমাধান সংবিধানের মধ্যেই রয়েছে। সংবিধান মেনে যদি সব রাজনৈতিক পক্ষ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে, তাহলে আর কোনো সমস্যা দেখি না।”

সংলাপের প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছেন বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। তিনি বেনারকে বলেন, “সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যে কোনো পরামর্শকেই আমরা স্বাগত জানাই। সংলাপ একটি সংকটের সুষ্ঠু সমাধানের উত্তম পথ হিসেবেই বিবেচনা করি আমরা।”

সংকট কেবল একটি উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমাদের এখানে কিন্তু সংকট একটিই, সেটি হচ্ছে নির্বাচনটা কীভাবে বা কার অধীনে অনুষ্ঠিত হবে। বর্তমান যে ব্যবস্থা আছে, অর্থাৎ দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন যে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নয়, তা গত দুই নির্বাচনে প্রমাণিত। তাই আমরা নির্বাচনকালীন দল নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করছি। এই বিষয়টি নিয়ে যে কোনো আলোচনাকে আমরা স্বাগত জানাই,” বলেন তিনি।

তবে সংলাপ প্রসঙ্গে ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, “শর্তযুক্ত কোনো সংলাপের ব্যাপারে আমাদের কোনো চিন্তাভাবনা নেই। শর্ত প্রত্যাহার করলে তখন দেখা যাবে।”

নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বেনারকে বলেন, “সংকট সমাধানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের পরামর্শ স্থানীয় বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘ দিন থেকেই দিয়ে আসছেন। এখন সেই একই পরামর্শ বিদেশি বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকেও এলো।

“সব রাজনৈতিক দলের উচিত দেশ যাতে কোনোভাবে অনিশ্চয়তার দিকে না যায়—সেটা খেয়াল রাখা। তাই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেই সমস্যা সমাধানের পথ বের করতে হবে,” যোগ করেন তিনি। 

যেভাবেই হোক নির্বাচন হবেই: প্রধানমন্ত্রী

শনিবার ঢাকায় একটি দলীয় কর্মসূচিতে বক্তৃতা করার সময় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, যেভাবেই হোক নির্বাচন এ দেশে হবেই এবং জনগণ স্বাধীনভাবে ভোট দেবে।

বিএনপি যেন কোনো অশুভ পদক্ষেপের মাধ্যমে আগামী জাতীয় নির্বাচন বানচাল করতে না পারে সে জন্য দেশবাসীকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি এ কথা বলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “তারা (বিএনপি) নাকি আমাদের উৎখাত করে দেবে। সময় দিয়েছিল ১০ ডিসেম্বর। বিজয়ের মাসে আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত করবে? যে সরকার জনগণের রায় নিয়ে বারবার নির্বাচিত হয়েছে। দেশের মানুষ এটা মেনে নিতে পারে না।”

নির্বাচনপূর্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনায় গত জুলাই মাসে বাংলাদেশ সফর করেছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল।

ওই পর্যবেক্ষক দলের সুপারিশের ভিত্তিতে আগামী জাতীয় নির্বাচনে বাংলাদেশে পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল না পাঠানোর সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।