বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়নি: যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য

বেনারনিউজ স্টাফ
2024.01.08
ওয়াশিংটন ডিসি
বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়নি: যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ঢাকার গণভবনে বিদেশি কূটনীতিক ও সাংবাদিকদের সাথে কথা বলছেন টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করতে যাওয়া আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৮ জানুয়ারি ২০২৪।
[রয়টার্স]

বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ ছিল না বলে সোমবার মন্তব্য করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সকল দলের অংশগ্রহণ না থাকায় নির্বাচনে জনগণের সম্পূর্ণরূপে ভোটদানের সুযোগ ছিল না বলে জানিয়েছে যুক্তরাজ্য।

তবে ভারত, রাশিয়া ও চীনসহ প্রায় এক ডজন দেশ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছে।

নির্বাচনে সকল দলের অংশগ্রহণ না থাকা "দুঃখজনক" হিসেবে আখ্যায়িত করে সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে দেয়া বিবৃতিতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে সমর্থন করে।

“অন্যান্য পর্যবেক্ষকদের সাথে যুক্তরাষ্ট্র একমত যে, নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়নি, এবং দুঃখজনকভাবে সকল দল এতে অংশগ্রহণ করেনি,” বলা হয় বিবৃতিতে।

সোমবার যুক্তরাজ্যের ফরেন কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট দপ্তরের বিবৃতিতে জানানো হয়, “গণতান্ত্রিক নির্বাচন নির্ভর করে বিশ্বাসযোগ্য, উন্মুক্ত ও অবাধ প্রতিযোগিতার ওপর। মানবাধিকারের প্রতি সম্মান, আইনের শাসন ও যথাযথ প্রয়োগ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। নির্বাচনকালে ওই মানদণ্ডগুলো সঠিকভাবে বজায় রাখা হয়নি।”

“সকল রাজনৈতিক দল এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। যার ফলে বাংলাদেশের জনগণের সম্পূর্ণরূপে ভোটদানে অংশগ্রহণের সুযোগ এতে ছিল না,” বলা হয় যুক্তরাজ্যের বিবৃতিতে।

নির্বাচনের আগে সহিংসতার নিন্দা জানিয়ে দুটি দেশই বিরোধী দলের অসংখ্য নেতাকর্মীর গ্রেপ্তারে উদ্বেগ প্রকাশ করে সব ধরনের সহিংসতা পরিহার করতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানায়।

প্রসঙ্গত, বিরোধী দলবিহীন অনেকটা একতরফা নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।

বাংলাদেশের নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টিকারীদের জন্য গত বছরের ২৪ মে ভিসা নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা দেবার পর সেপ্টেম্বর থেকে তার প্রয়োগ শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র।

গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি অঙ্গীকার বাস্তবায়নের আহ্বান

বাংলাদেশের নবনির্বাচিত সরকারকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি অঙ্গীকার বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার টুর্ক।

সোমবার জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার অফিসের (ওএইচসিএইচআর) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রেস বিবৃতিতে বলা হয়, “রোববারের নির্বাচনী পরিবেশ সহিংসতা এবং বিরোধী প্রার্থী ও সমর্থকদের ওপর দমন-পীড়নের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে” বলে হাইকমিশনার দুঃখ প্রকাশ করেছেন।

টুর্ক বলেন, ভোটের আগের কয়েক মাসে হাজারো বিরোধী সমর্থককে নির্বিচারে আটক করা হয়েছে বা ভয় দেখানো হয়েছে। এ ধরনের কৌশল কোনো সত্যিকারের প্রকৃত প্রক্রিয়ার জন্য সহায়ক নয়।

বিবৃতিতে বলা হয়, অভিযোগ রয়েছে, ভোটের আগে গণহারে গ্রেপ্তার, হুমকি, জোরপূর্বক গুম, ব্ল্যাকমেইলিং ও নজরদারি ইত্যাদি পদ্ধতি ব্যবহার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এই ভোট প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বয়কট করেছে।

“আমি সরকারকে অনুরোধ করছি যাতে সকল বাংলাদেশির মানবাধিকার সম্পূর্ণরূপে বিবেচনায় নেওয়া হয় এবং দেশে সত্যিকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্রের ভিত্তিকে শক্তিশালী করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়,” বলেন তিনি।

টুর্ক বলেন, “এসব ঘটনার অবশ্যই স্বাধীনভাবে তদন্ত করা উচিত এবং দায়ী ব্যক্তিদের অবশ্যই সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ বিচারপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচারের আওতায় আনতে হবে।”

হাইকমিশনার বলেন, 'বাংলাদেশ কঠিন সংগ্রামের মাধ্যমে গণতন্ত্র ফিরে পেয়েছে, তাই এটিকে ছেলেখেলায় পরিণত করা উচিত নয়। সব বাংলাদেশির ভবিষ্যৎ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।

অবস্থান স্পষ্ট করেছে কানাডা

সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণে কানাডা সরকারের পক্ষ থেকে কোনও পর্যবেক্ষক পাঠানো হয়নি বলে জানিয়েছে বাংলাদেশে অবস্থিত কানাডা হাইকমিশন।

দেশটি বলছে, পর্যবেক্ষক হিসেবে চিহ্নিত কানাডার দু’জন নাগরিক স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছেন। কাজেই নির্বাচন নিয়ে তাঁদের দেওয়া মতামতের সাথে কানাডা সরকারের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।

উল্লেখ্য, রোববার অনুষ্ঠিত নির্বাচন পর্যবেক্ষণ শেষে সন্ধ্যায় ঢাকার একটি হোটেলে সংবাদ সম্মেলন করেন বিদেশি পর্যবেক্ষকদের একটি দল।

সেখানে চন্দ্রকান্ত আর্য ও ভিক্টর ওহ নামে কানাডার দু'জন নাগরিক অংশ নেন। তখন “ভোট সুষ্ঠুভাবে শেষ হয়েছে” বলে সাংবাদিকদের জানান চন্দ্রকান্ত।

এ বিষয়ে হাইকমিশন সোমবার বলেছে, এটা পর্যবেক্ষকদের ব্যক্তিগত মত, কানাডা সরকারের নয়।

এর বাইরে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচন নিয়ে কোনো দাপ্তরিক মন্তব্য করেনি কানাডা।

us-uk2.jpeg
নয়া দিল্লিতে জি২০ সামিটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাম থেকে: বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিউ লুলা দা সিলভা। ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩। [এএফপি]

ভারত, রাশিয়া ও চীনের অভিনন্দন

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারত, রাশিয়া ও চীনসহ প্রায় এক ডজন দেশ অভিনন্দন জানিয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশকে অব্যাহত সমর্থন দেয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে এসব দেশের পক্ষ থেকে।

প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং থেকে সোমবার এই তথ্য জানানো হয়। তাছাড়া এসব দেশের পক্ষ থেকেও সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে অভিনন্দনের বিষয়টি জানানো হয়েছে।

ভারত, রাশিয়া, চীন, ভুটান, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর ও শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রদূতেরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁদের ধন্যবাদ জানানোর পাশাপাশি বাংলাদেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় সহযোগিতা কামনা করেন।

এ ছাড়া নেপাল, পাকিস্তান, ব্রাজিল ও মরক্কোর রাষ্ট্রদূতেরা নিজ নিজ দেশের পক্ষ শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা জানান।

শেখ হাসিনাকে মোদির টেলিফোন

আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টেলিফোনে অভিনন্দন জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

এ বিষয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অ্যাক্সে অ্যাকাউন্টে লিখেছেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলেছি এবং সংসদ নির্বাচনে টানা চতুর্থবারের মতো ঐতিহাসিক বিজয়ের জন্য তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছি। আমি বাংলাদেশের জনগণকেও অভিনন্দন জানাই। আমরা বাংলাদেশের সাথে আমাদের স্থায়ী এবং জনকেন্দ্রিক অংশীদারিত্বকে আরও জোরদার করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”

উল্লেখ্য, বর্তমান সরকারে সময়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ ও বাণিজ্য খাতে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।

২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যে রুপিতে লেনদেনের জন্য বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনুমতি দেয়।

ওই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ভারত থেকে বছরে প্রায় ১৪ বিলিয়ন বা ১৪০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। বিপরীতে দুই বিলিয়ন বা দুইশো কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ।

এদিকে ২০২২ সালে জুনে উদ্বোধন হওয়া বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়ো অবকাঠামো পদ্মা সেতু নির্মাণ করে চীনা কোম্পানি, যার মোট ব্যয় দাড়ায় ৩২ হাজার ৬৩৮ কোটি টাকা। বাংলাদেশে চীনা ঋণে বিদ্যুত, সড়ক, সেতুসহ বিভিন্ন খাতের বড়ো বড়ো প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে।

রাশিয়ার অর্থায়নে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ শেষের পথে। এতে রাশিয়ার অর্থায়নের পরিমাণ ১ হাজার ২৬৫ কোটি ডলার, যার ৯০ শতাংশই ঋণ। চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের সব কাজ করছে রাশিয়ারই কোম্পানি।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে অয়ন আমান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।