বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি, ৩ বছরের মধ্যে বিদুৎখাত ভর্তুকিমুক্ত করার ঘোষণা
2024.02.27
ঢাকা
বাংলাদেশ সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে আগামী তিন বছরের মধ্যে এই খাত ভর্তুকিমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেওয়ার শর্ত হিসেবে সরকারকে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বন্ধ করতে হবে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে ওই ঋণের দুটি কিস্তি পেয়েছে।
মঙ্গলবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানিয়েছেন, আগামী মার্চ থেকে বাড়তি দাম কার্যকর হবে। এবার প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৩৪ পয়সা থেকে ৭০ পয়সা পর্যন্ত বাড়ছে।
গত ৭ জানুয়ারি টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় আসার দুই মাস কম সময়ের মধ্যে বিদ্যুতের দাম বাড়াল সরকার। এর আগে গত বছরের মার্চে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছিল।
তবে ব্যবসায়ী ও সাধারণ গ্রাহকদের মতে, বৈশ্বিক পরিস্থিতি ও ডলার সংকটের কারণে দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, বেড়েছে দ্রব্যমূল্য। এই অবস্থায় বিদ্যুতের দাম বাড়লে দেশের অনেক শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এছাড়া সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় এর মারাত্মক প্রভাব পড়বে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ তথ্য কর্মকর্তা মীর আসলাম উদ্দিন জানিয়েছেন, সরকারি হিসেবে বিদ্যুৎ খাতে বর্তমানে রাষ্ট্রের ভর্তুকির পরিমাণ ৪৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) লোকসান গুনেছে ১১ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকার বেশি।
বিদ্যুৎ খাতে রাষ্ট্রের দেয়া এই বিশাল ভর্তুকি আগামী তিন বছরে তুলে নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন নসরুল হামিদ।
বিদ্যুৎ বিলের রকমফের
বর্তমান দর অনুযায়ী, কোনো আবাসিক গ্রাহক মাসে সর্বোচ্চ ৫০ ইউনিট ব্যবহার করলে প্রতি ইউনিটের বিল দিতে হয় চার টাকা ৩৫ পয়সা। সর্বোচ্চ ব্যবহার ৭৫ ইউনিট হলে প্রতি ইউনিটের বিল দিতে হয় চার টাকা ৮৫ পয়সা।
এছাড়া, ৭৬-২০০ ইউনিট ছয় টাকা ৬৩ পয়সা; ২০১-৩০০ ইউনিট ছয় টাকা ৯৫ পয়সা; ৩০১-৪০০ ইউনিট সাত টাকা ৩৪ পয়সা; ৪০১-৬০০ ইউনিট ১১ টাকা ৫১ পয়সা এবং ৬০০ ইউনিটের বেশি ব্যবহার হলে প্রতি ইউনিটের জন্য খরচ গুনতে হয় ১৩ টাকা ২৬ পয়সা।
দাম বাড়ানোর ফলে নির্ধারিত স্ল্যাবে প্রতি ইউনিটে ৩৪ পয়সা থেকে ৭০ পয়সা যোগ হবে।
ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা
দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, বাংলাদেশের শিল্প-কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য দুটি মৌলিক উপাদানের ওপর নির্ভর করে। একটি হলো তেল, আরেকটি গ্যাস।
তিনি বলেন, “আমরা ব্যবসায়ীরা বর্তমানে চাপে আছি। প্রতিকূল বৈশ্বিক পরিস্থিতি, ডলার সংকটসহ বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত। এই অবস্থায় বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি আমাদের জন্য বাড়তি চাপ।”
“সরকার বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করবে, তাতে কোনো অসুবিধা নেই,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সমস্যা হলো, বিশ্ব বাজারে তেল-গ্যাসের দাম বাড়লে সরকার দেশের বাজারে দাম বাড়ায়। কিন্তু বিশ্ব বাজারে দাম কমলে তখন কমায় না। আমরা বেশি দাম দিয়ে প্রয়োজন মোতাবেক বিদ্যুৎ পাই না।”
তিনি বলেন, বিদ্যুতের দাম বাড়লে আমাদের উৎপাদন খরচ বাড়বে। তৈরি পোশাক খাতে কিছু বড়ো বড়ো কোম্পানি ছাড়া বাকিরা ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবে না, বিশেষ করে যারা সাব-কনট্রাক্টে কাজ করে।
“সরকারের উচিত ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া,” যোগ করেন তিনি।
দাম বাড়বে সব কিছুর
অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, বিদ্যুৎ এমন একটি পণ্য, যার দাম বাড়লে সব কিছুর দাম বাড়বে।
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, বিদ্যুতের দাম বাড়লে সেচের খরচ বাড়বে, তাতে ধানের উৎপাদন খরচ বাড়বে। চালের দাম বাড়বে, ফলে সাধারণ মানুষের বাড়তি খরচ হবে।
আইএমএফের শর্ত পূরণের জন্য সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আইএমএফ বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বন্ধ করতে বলেছে। আমিও মনে করি, আমাদের ভর্তুকির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। কিন্তু আইএমএফ বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি বন্ধ করতে বলেনি। এটি ভুল ধারণা।”
মোয়াজ্জেম বলেন, “আমাদের বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি কমানোর জন্য প্রথমেই বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোকে বসিয়ে রেখে টাকা (ক্যাপাসিটি চার্জ) দেওয়া বন্ধ করা দরকার। কোম্পানিগুলোর সঙ্গে নতুন করে আলোচনা করে উৎপাদনের ভিত্তিতে টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে, আমাদের ভর্তুকির টাকা দেওয়া লাগবে না।”
এদিকে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো “ভালো সিদ্ধান্ত নয়” বলে মঙ্গলবার বেনারের কাছে মন্তব্য করেন রাজধানীর শেরেবাংলানগরের বাসিন্দা ফজলুর রহমান।
“এই সিদ্ধান্ত দেশের সাধারণ মানুষকে সরাসরি আঘাত করবে,” জানিয়ে তিনি বলেন, “দেশের সাধারণ মানুষ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশাহারা। এই অবস্থায় বিদ্যুতের দাম বাড়ালে প্রতিটি নিম্নবিত্ত পরিবারের মাসিক বিদ্যুৎ বিল ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা বাড়তে পারে। এটি গরিব মানুষের জন্য অনেক বড়ো চাপ।”
তিনি বলেন, গ্যাস সংকটের কারণে অনেক মানুষ রান্নার কাজে হিটার, রাইস কুকার ব্যবহার করেন। বিদ্যুৎ বিল বাড়ানোর ফলে সেটাও কঠিন হবে। ঢাকাসহ সারা দেশে লাখ লাখ অটোরিকশা আছে, যেগুলো বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল। বিদ্যুতের দাম বাড়লে চার্জ স্টেশনগুলো বেশি টাকা নেবে এবং চালকরা সেই টাকা জনগণের কাছ থেকে আদায় করবে।
গ্যাসের দাম প্রতি ইউনিটে বাড়ল ৭৫ পয়সা
সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের কেন্দ্রের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে ব্যবহৃত প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ১৪ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৪ টাকা ৭৫ পয়সা নির্ধারণ করেছে সরকার।
নতুন দাম চলতি ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হবে বলে এক প্রজ্ঞাপনে জানিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।
এছাড়া শিল্পে উৎপাদিত নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রের (ক্যাপটিভ) জন্য ইউনিট প্রতি গ্যাসের দাম ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা ৭৫ পয়সা করা হয়েছে।
প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, বাংলাদেশে গ্যাস ব্যবহারকারীদের আটটি গ্রাহক শ্রেণি রয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৩৭ শতাংশ, শিল্পে ২৩, ক্যাপটিভ বিদ্যুতে ১৮, গৃহস্থালিতে ১০, সার উৎপাদনে সাত, সিএনজিতে চার এবং বাণিজ্যিক ও চা শিল্পে এক শতাংশ গ্যাস ব্যবহৃত হয়।
প্রাকৃতিক গ্যাসের উৎপাদন, আমদানি, সরবরাহ মূল্যের সঙ্গে বিক্রি মূল্যের পার্থক্যের কারণে সরকারকে এ খাতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ছয় হাজার ৫৭০ কোটি ৫৪ লাখ টাকা ভর্তুকি দিতে হবে।