আকাশ ছোঁয়া নিত্যপণ্যের দাম, খরচ কমিয়েও কুলাতে পারছে না নিম্ন আয়ের মানুষ

রিয়াদ হোসেন
2023.11.10
ঢাকা
আকাশ ছোঁয়া নিত্যপণ্যের দাম, খরচ কমিয়েও কুলাতে পারছে না নিম্ন আয়ের মানুষ ঢাকার কারওয়ান বাজার থেকে কাঁচা সবজি কিনছেন ক্রেতারা। ২০ অক্টোবর ২০২৩।
[বেনারনিউজ]

ঢাকায় ব্যক্তিগত গাড়ি চালান রবি আলম, থাকেন এলিফ্যান্ট রোড এলাকায়। চার মাস আগে তিন হাজার টাকা বেশি বেতনে নতুন চাকরি নিলেও খরচ কুলাতে না পেরে বছরখানেক আগে স্ত্রী ও দুই বছর বয়সী একমাত্র সন্তানকে ভোলার দৌলতখানে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন।

রবির এখন মাসিক আয় ২২ হাজার টাকা। তিনি বলেন, “আগে ১৯ হাজার টাকা বেতন পেলেও নিজের খরচ রেখে গ্রামের বাড়িতে প্রায় ১২ হাজার টাকা পাঠাতে পারতাম। এখন ১০ হাজার টাকার বেশি দিতে পারি না।”

খরচ বেড়েছে প্রায় সব খাতে,” বলেন রবি।

রবি জানান, প্রতিমাসে তাঁকে মেসে দিতে হয় আড়াই হাজার টাকা, দুই বেলা খাওয়ার খরচে যায় চার হাজার টাকা, সকালের নাস্তায় প্রায় দেড় হাজার টাকা।

দুই বছর আগেও এক কাপ চা খেতাম ছয় টাকায়, এখন ১০ টাকা। মোবাইল ফোন খরচ তো আছেই। বাড়িতেও খরচ বেড়েছে। সেখানেও বাড়তি টাকা দরকার,” বলেন ৩৪ বছর বয়সী রবি।

রবি জানান, খরচ কমানোর জন্য তাঁর গ্রামের বাড়িতে “মাংস কেনা হয় না বললেই চলে।”

মেয়েটি আলু খেতে পছন্দ করে,” কিন্তু মাসের শুরুতে গ্রামের বাজারে গিয়ে তাঁর স্ত্রী প্রতি কেজি কেজি ৭০ টাকা শুনে আলু না কিনেই “সেদিন শুধু ডাল কিনেছে,” জানান রবি।

মাসে দুই-একবার মাংস কিনি

ঢাকা ওয়াসার কাওরানবাজার অফিসে ১৬তম গ্রেডে চাকরি করেন আরিফুল ইসলাম (আসল নাম নয়)। তাঁর এক ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, আরেক ছেলে স্কুলে। স্ত্রী ও ছেলেদের নিয়ে নিয়ে ৫০ বছর বয়সী আরিফুল থাকেন পল্লবীতে ওয়াসার সরকারি কোয়ার্টারে।

বর্তমানে তাঁর বেতন প্রায় ৪০ হাজার টাকা। বাসা ভাড়া হিসেবে তাঁর বেতন থেকে প্রতিমাসে প্রায় ১২ হাজার টাকা কেটে নেওয়া হয়।

আরিফুল জানান, গত দুই বছরে তাঁর বেতন দুই হাজার টাকা বেড়েছে, কিন্তু জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ।

প্রতি মাসে ওষুধের কিছু খরচ আছে, সেটি কমাতে পারছি না। খাবারের ব্যয় আগের চেয়ে কমিয়ে দিতে হয়েছে,” বলেন আরিফ।

তিনি বলেন, “মাসে দুই-একবার মাংস কিনি—কোনো মাসে কিনি না। বিয়েসহ সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ কমিয়েছি। এছাড়া বাইরে ঘুরতে যেতাম, সেটাও কমিয়েছি।”

বেতন না বাড়ুক, জিনিসপত্রের দাম কমুক”

চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার বাসিন্দা শম্পা আক্তার গত ২০ বছর ধরে পোশাক কারখানায় কাজ করছেন। এর মধ্যে গত ১০ বছর ধরে কাজ করছেন রাজধানীর তেজগাঁও এলাকার আরমানা অ্যাপারেলস লিমিটেড নামে একটি কারখানায়।

গ্রামের বাড়িতে প্রতিবন্ধী ভাই ও অসুস্থ এক বোনের জন্য প্রতি মাসে কিছু টাকা পাঠাতে হয়। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন কেবল প্রতিবন্ধী ভাইটির জন্য কিছু টাকা পাঠান। খরচ বাঁচাতে মহাখালীতে তিন জন মিলে এক রুমে থাকছেন। আগে মাসে দুই হাজার টাকা করে জমাতে পারতেন, এখন আর পারছেন না।

এর মাঝে গত জানুয়ারিতে তাঁর ঘরভাড়া ৫০০ টাকা বেড়েছে বলে জানান শম্পা।

তেলাপিয়া মাছ কিনি আধা কেজি করে, দামের কারণে অন্য মাছ কিনতে পারি না। ৩০ টাকা কেজি দরের পেঁপে কিনি, এটা সবচেয়ে কম দামের সবজি। ছয় মাসেও একবার গরুর মাংস কিনি না, দুই মাসে ব্রয়লার মুরগি কিনি একবার,” এভাবেই খরচ সামলানোর বিবরণ বেনারকে জানান শম্পা।

তিনি বলেন, “কিছু দিন আগে অসুস্থ হয়েছিলাম, দুধ-ডিম খাওয়া দরকার। কিন্তু কেনার সাহস পাচ্ছি না। যে টাকায় দুধ-ডিম কিনব, ওই টাকায় এক সপ্তাহের বাজার খরচ হয়ে যাবে।”

তাঁদের ন্যূনতম মজুরি সরকার আরও বাড়াবে আশা করে শম্পা বলেন, “আমরা বেতন বাড়াতে বললে শ্রমিকদের ওপর হামলা হয়, মেরে ফেলা হয়। বেতন না বাড়ুক, জিনিসপত্রের দাম কমুক!”

প্রসঙ্গত, ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে তৈরি পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলনের সময় দুই পোশাক শ্রমিক নিহত হয়েছেন। বৃহস্পতিবারও গাজীপুরে শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষ হয়েছে।

6a20c52c-05b2-4a7d-bf76-eb2801fd97d3.jpg
পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে ঢাকার তোপখানা রোডে নিম্নতম মজুরি বোর্ডের সামনে শ্রমিকদের বিক্ষোভ। ৭ নভেম্বর ২০২৩। [বেনারনিউজ]

মধ্য আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস উঠে গেছে’

বৃহস্পতিবার ঢাকার মালিবাগে দেশব্যাপী এক কোটি স্মার্ট ফ্যামিলি কার্ড বিতরণ অনুষ্ঠানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বাজার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর হতে বাণিজ্যমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, মধ্য আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস উঠে গেছে।

ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী। বাজার নিয়ন্ত্রণে তিনি সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছেন বলে জানান।

গত এক বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ উচ্চ মূল্যস্ফীতি মোকাবিলা করছে। এই পরিস্থিতির জন্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বেশ কিছু আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া ছাড়াও স্থানীয় কারণ রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষত ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা টাকা গত এক বছরে দর হারিয়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ, যা আমদানিকৃত সব পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব বলছে, গত প্রায় এক বছর ধরেই মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ ছুঁই ছুঁই। সর্বশেষ গত আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি সাড়ে ১২ শতাংশ ছাড়িয়েছে, যা ছিল বিগত প্রায় এক যুগে একক মাসে সর্বোচ্চ।

গত সোমবার বিবিএস প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, অক্টোবরের খাদ্য মূল্যস্ফীতি আগস্টের চেয়েও বেড়েছে।

এমন পরিস্থিতি একদিকে মানুষ খরচ কমিয়ে দিয়েছে, অন্যদিকে টিকে থাকার জন্য সঞ্চয় ভাঙতে হচ্ছে।

দুই বছর আগে চট্টগ্রামের মূল শহরে থাকতেন সিদ্দিকুর রহমান হারুন। বাসা ভাড়া বাবদ ব্যয় সংকোচনের জন্য এখন কিছুটা দূরে হাটহাজারী এলাকায় থাকছেন।

ব্যয়ের কুলাতে না পেরে ব্যাংকে থাকা সঞ্চয় ভেঙে চলতে হচ্ছে তাঁকে।

ছোট দু’টি মেয়ে কিছু চাইলেও কিনে দিতে পারি না। অথচ অতীতে কখনো এতটা খারাপ অবস্থায় ছিলাম না,” বেনারকে বলেন সিদ্দিকুর।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা কাজে আসছে না

বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার গত সেপ্টেম্বরে সরকার ডিম, আলু ও পেঁয়াজের দাম নির্ধারণ করে দেয়। তবে বাজার যাচাই করে দেখা গেছে, এর কোনোটিই নির্ধারিত দামে বিক্রি হচ্ছে না। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) খুচরা বাজারের পর্যালোচনা তথ্যেও একই চিত্র উঠে এসেছে।

গত অক্টোবরের শেষ দিকে আলুর দাম রীতিমতো রেকর্ড ৭০ টাকা কেজি দরেও বিক্রি হয়েছে। অথচ সরকার নির্ধারণ করে দিয়েছিল ৩৫ টাকা। একইভাবে পেঁয়াজ নির্ধারিত ৬৫ টাকার চেয়ে দ্বিগুণ বা তারও বেশি দামে বিক্রি হয়েছে।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর সহসভাপতি এস এম নাজের হোসেন বেনারকে বলেন, “জাতীয় নির্বাচনের আগে ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট আরও শক্তিশালী হয়েছে। তাদের নিয়ন্ত্রণে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। এই ভার বহন করতে হচ্ছে ভোক্তাকে। যে পরিমাণ আলু আছে, তাতে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়, অথচ দাম বাড়ছে।” 

পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতায় সরকারের সমালোচনায় সরব সংসদের বিরোধী দলও। গত ১ নভেম্বর সংসদে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, “ভারতে পেঁয়াজের দাম বাড়লে দেশে কেজি ১৫০ টাকা হয়ে যায়। বাংলাদেশে কোথাও নিয়ন্ত্রণ আছে…সরকার আছে এটা আমরা টের পাই না।”

দাম কমাতে সরকার প্রায় দুই মাস ধরে ১৫ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দিয়েছে। গত ৬ নভেম্বর মাত্র ৬২ হাজার পিস ডিম দেশে এসেছে, যা বাজারে বিশেষ প্রভাব ফেলতে পারেনি।

অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ মনে করেন, যে মূল্যস্ফীতি চলছে তা থেকে আশু উত্তরণের সম্ভাবনা কম।

বেনারকে তিনি বলেন, “রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়তে থাকলে ভবিষ্যতে যদি সরবরাহ সংকট তৈরি হয়, তাহলে মূল্যস্ফীতি না কমে বরং বাড়তেও পারে।”

সিন্ডিকেট ও ফটকা ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা মূল্যস্ফীতি বাড়ার অন্যতম কারণ উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের এই অধ্যাপক বলেন, এক্ষেত্রে সরকার কার্যকর উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। এর সাথে ভূমিকা রেখেছে ডলার সংকট, প্রবাসী আয় দেশে আনতে না পারা ও ডলার পাচার।

এখন এ সমস্যা সমাধানে বেসরকারি খাতের উপর ভরসা না করে সরকারি প্রতিষ্ঠান টিসিবির মাধ্যমে পণ্য আমদানি করে সরবরাহ বাড়াতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।