মূল্যবৃদ্ধির চাপে কম পণ্য কিনে টিকে থাকার চেষ্টায় স্বল্প আয়ের মানুষ

রিয়াদ হোসেন
2023.03.22
ঢাকা
মূল্যবৃদ্ধির চাপে কম পণ্য কিনে টিকে থাকার চেষ্টায় স্বল্প আয়ের মানুষ চাল, ডালসহ নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি রোধের দাবিতে ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বাম গণতান্ত্রিক জোটের বিক্ষোভ সমাবেশ। ২২ মার্চ ২০২৩।
[বেনারনিউজ]

অত্যাবশ্যকীয় ও নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য কম কিনে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন স্বল্প আয়ের মানুষ। রমজান মাসে দ্রব্যমূল্যের চাপ আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

তাঁরা বলছেন, মূল্যস্ফীতির চাপে থাকা মানুষের ব্যয় কমার আশা দেখা যাচ্ছে না। সরকারি তথ্যমতে, গত ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে প্রায় ৯ শতাংশ দাঁড়িয়েছে। আগের পাঁচ মাসের মধ্যে এটি সর্বোচ্চ আর গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় তিন শতাংশ বেশি।

একই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।

মঙ্গলবার ঢাকার শেরেবাংলা নগরে এক সভা শেষে গণমাধ্যমকর্মীদের তিনি বলেন, “ফেব্রুয়ারিতে (মূল্যস্ফীতি) সামান্য কিছু বৃদ্ধি পেয়েছে। আমার ধারণা, মার্চে আরেকটু বাড়বে। কারণ মার্চ আবহমানকাল থেকেই মঙ্গার মাস। ঘরের খাবার ফুরিয়ে যায়।”

রোজার আগে মানুষ বিভিন্ন পণ্য ঘরে মজুত রাখে সেটাও মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে বলে মনে করেন তিনি।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের পাশাপাশি সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের ব্যর্থতায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বেনারকে বলেন, “এটি (মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকা) সরকারের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যর্থতা। সরকার মুদ্রানীতি ব্যবহার করে এটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারত।”

সরকারের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র হিসাব অনুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারিতে খাদ্য ও খাদ্য বহির্ভূত পণ্য মিলিয়ে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ। অথচ গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ছিল ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ।

কেনা কমাতে বাধ্য হচ্ছি’

রাজধানীর শ্যাওড়াপাড়া সপরিবারে বসবাস করেন মুরাদ হোসেন। তাঁর পরিবারে স্ত্রী ছাড়াও রয়েছে দুই সন্তান। মুরাদ একটি প্রতিষ্ঠানে কনটেন্ট রাইটার হিসেবে কাজ করেন।

তিনি মঙ্গলবার রাতে বেনারকে বলেন, “গত এক বছরে আমার আয় বাড়েনি। কিন্তু পণ্যমূল্য এত বেড়েছে যে, এখন নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য কেনা কমিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছি। আগে মাসে পাঁচ লিটার সয়াবিন তেল কিনতাম। এখন সাড়ে তিন লিটারে সমন্বয় করছি। আগে মাসে পাঁচটি মুরগি কিনতাম, এখন মাসে হয়তো একটা কিনছি।”

নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য নয় এমন অনেক কিছু কেনা বাদ দিয়েছেন বলে জানান মুরাদ।

সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মূল্য তালিকা দেখলে বাজার পরিস্থিতি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

টিসিবি’র দেওয়া বুধবারের বাজারদর পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, গত এক বছরের ব্যবধানে ডিমের দাম বেড়েছে ২২ শতাংশ। একই সময়ে চিনির দাম ৪৯ শতাংশ, খেজুর ২৬ শতাংশ, লবণ ২৩ শতাংশ, গুঁড়ো দুধ ২৪ থেকে ৩৯ শতাংশ, ব্রয়লার মুরগি ৬৩ শতাংশ, গরুর মাংস ৯ শতাংশ, ছোলা ১৭ শতাংশ, মসুর ডাল ৮ শতাংশ, সয়াবিন তেল ১১ শতাংশ এবং আটার দাম ৫৬ শতাংশ বেড়েছে।

একই সময়ে চালের দাম সামান্য বাড়লেও কমেছে পেঁয়াজের দাম।

আগামী ২৪ মার্চ (শুক্রবার) থেকে শুরু হচ্ছে রমজান মাস। রমজানের আগে ডিম, মুরগির মাংসসহ কিছু পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে নতুন উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।

ক্রেতাদের অভিযোগ, টিসিবি যে মূল্য তালিকা দিচ্ছে কোনো কোনো এলাকায় তার চেয়ে বেশি দামে পণ্য বিক্রি হচ্ছে।

রাজধানীর একাধিক বাজার ঘুরে ক্রেতাদের এই অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে বেনার।

বাজারে ক্রেতা কম

কাফরুল এলাকায় অবস্থিত ইব্রাহিমপুর বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সাধারণ রমজানের আগে যে সংখ্যক ক্রেতা দেখা যেত এবার তেমনটা দেখা যাচ্ছে না। একই মত দেন বাজারের ব্যবসায়ী জামাল জেনারেল স্টোরের মালিক মোহাম্মদ জামাল।

তিনি বেনারকে বলেন, “অন্যান্য সময় রোজার আগে বাজারে প্রচুর মানুষ (ক্রেতা) থাকত। এখন বাজারে মানুষ আছে? কয়জনের কাছে টাকা আছে!”

বৌ বাজার এলাকার চিত্রও ছিল একই রকম।

দেশের অন্যতম প্রধান বাজার কারওয়ানবাজার ঘুরেও দেখা গেছে, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার ক্রেতা কম।

মূল্যস্ফীতি মূলত চার কারণে

অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (রেপিড) চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক বেনারকে বলেন, “রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া, স্থানীয়ভাবে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম বৃদ্ধি এবং ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফা লাভের মনোভাব সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। এগুলো মূল্যস্ফীতির কারণ।”

ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, “বিশ্ববাজারে সম্প্রতি পণ্যমূল্য কমে আসছে এবং অন্যান্য দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতিও কমতির দিকে।”

এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন ড. রাজ্জাক।

দেশে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনে সরকারের মুদ্রানীতিকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে না পারার ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন ড. মনসুর।

বাংলাদেশে অতীতে মূল্যস্ফীতি ৫ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে থাকত। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পরে গত আগস্টে তা বেড়ে প্রায় ১০ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছায়। গত এক যুগের মধ্যে যা ছিল সর্বোচ্চ। এর পরের মাসগুলোতে সামান্য কমতে থাকলেও ফেব্রুয়ারিতে এসে আবারো বাড়তে শুরু করে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।