দুই সপ্তায় কাঁচা মরিচের দাম বেড়েছে চার গুণ, আমদানি শুরু
2023.06.27
ঢাকা
গত দুই সপ্তার ব্যবধানে রান্নার অন্যতম উপকরণ কাঁচা মরিচের দাম খুচরা পর্যায়ে কেজিতে চার গুণ বেড়ে ১০০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা হয়েছে। কোনো কোনো জায়গায় এর চেয়েও বেশি দামে তা বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি বেড়েছে অন্যান্য নিত্যপণ্যের দামও।
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চাপ ও দেশে মূল্যস্ফীতি গত ১১ বছরে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায় জনজীবনে নেমে এসেছে বাড়তি চাপ।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দেশের কোথাও কোথাও অতিবৃষ্টির কারণে কাঁচা মরিচের ক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে। যদিও ক্রেতাদের অনেকেই চার গুণ মূল্য বৃদ্ধির জন্য সরকারের এমন যুক্তি মানতে নারাজ।
বাংলাদেশে ঈদুল আযহা উদযাপিত হবে ২৯ জুন। ঈদের সময় শসা, টমেটো, কাঁচা মরিচের চাহিদা বাড়ায় প্রতি বছরই এসব পণ্যের দাম কিছুটা বেশি থাকে। কিন্তু ক্রেতাদের অভিযোগ, এবার ঈদের আগে এসব পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে।
মঙ্গলবার রাজধানীর দুটি পাইকারি ও খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, কেবল এসব পণ্য নয়, হঠাৎ করে মাছ, মুরগি ও গরুর মাংসের দাম বেড়েছে। ঈদের আগের দিন বুধবার মুরগি ও মাংসের দাম আরও বাড়তে পারে বলে আভাস দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
বেড়েছে চিনির দামও। ঈদ সামনে রেখে জিরা, আদাসহ বেশ কিছু মসলার দামও চড়া। এক বছরের ব্যবধানে জিরার দাম বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি।
কাঁচা মরিচের দামে লাগাম টানতে সরকার আমদানির অনুমতি দিয়েছে। মঙ্গলবার ভারত থেকে আমদানি করা কাঁচা মরিচ বাজারে উঠেছে। তা সত্ত্বেও ঢাকার খুচরা বাজারগুলোতে দামে তেমন প্রভাব পড়েনি।
ক্রেতারা বলছেন, আরও আগে আমদানির অনুমতি দিলে দাম কমে আসত।
তবে ঈদের পর কাঁচা মরিচসহ এসব পণ্যের দাম কমে আসবে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।
“কাঁচা মরিচ আমদানি শুরু হয়েছে। আশা করছি, দাম কমতে শুরু করবে,” মঙ্গলবার বেনারকে বলেন বাণিজ্যমন্ত্রী।
‘দামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারছি না’
রাজধানীর বড়ো পাইকারি বাজারে আমদানিকৃত কাঁচা মরিচ আসতে শুরু করলেও খুচরা বাজারে এর প্রভাব পড়েনি।
ঢাকার দক্ষিণখানের বাসিন্দা নূরুল মোমিন একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন। তিনি বেনারকে বলেন, “ক্রমাগত দাম বাড়ছে কিন্তু আমাদের আয় তো নির্দিষ্ট।”
ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়াচ্ছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, “যাদের বাজার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব, তারা সেটি করতে পারছেন না।”
কেবল রাজধানীতে নয়, দেশের অন্যান্য জেলাগুলোতে মূল্য বৃদ্ধির চাপে মানুষের নাকাল অবস্থা। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুরের বাসিন্দা মুক্তার হোসেন জানান, সেখানেও মঙ্গলবার এক কেজি পেঁয়াজ ৪০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
“দামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারছি না,” বেনারকে বলেন তিনি।
“যেখানে এক কেজি কিনতাম, এখন আধা কেজি কিনছি। যেটি পাঁচ কেজি দরকার, তিন কেজি কিনছি,” বলেন মুক্তার হোসেন।
নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য পাইকারি ও খুচরা বিক্রির জন্য পরিচিত রাজধানীর কারওয়ান বাজার।
মঙ্গলবার কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা গেছে, খুচরা প্রায় সব পণ্যের দাম ১৫ দিন আগের তুলনায় বেশি।
দুই সপ্তাহ আগে প্রতি কেজি দেশি টমেটো ৬০ থেকে ৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও মঙ্গলবার ১২০ টাকা আর ভারত থেকে আমদানি করা টমেটো ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। প্রতি কেজি শসা দুই সপ্তাহের ব্যবধানে দ্বিগুণ বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকায়। তেলাপিয়া মাছের কেজি ৩০০ টাকা।
মাংসের দাম আরো বাড়তে পারে
রাজধানীর হাতিরপুল বাজারে দেখা গেছে, প্রতি কেজি তেলাপিয়া বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকায়, যা দুই মাস আগেও সর্বোচ্চ ২২০ টাকায় বিক্রি হতো। তেলাপিয়া মাছ বাজারে অপেক্ষাকৃত কম দামে পাওয়া যায়। স্বল্প আয়ের মানুষ সাধারণত এই মাছের মূল ক্রেতা।
জাকির হোসেন নামে বিক্রয়কর্মী বেনারকে বলেন, “কিছু করার নেই, বেশি দামে আমাদের কিনতে হয়।”
হাতিরপুল বাজারের আরেক মাছ বিক্রেতা মিজানুর রহমান জানান, মঙ্গলবার অন্তত ৫০ টাকা বেশি দামে প্রতি কেজি মাছ কিনতে হয়েছে তাঁদের।
দুই মাস আগে ৭৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া গরুর মাংস মঙ্গলবার বিক্রি হচ্ছিল ৮০০ টাকা দরে। দোকানকর্মী বশির উদ্দিন আরও বেশি দামে বিক্রি হওয়ার আভাস দিয়ে বলেন, “কাল (বুধবার) ৮৫০ টাকায় বিক্রি করতে হবে।”
মুরগির মাংসের দামও বুধবার বাড়তে পারে বলে জানান দোকানকর্মীরা।
সরবরাহ কম, বেড়েছে খরচ
পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরবরাহ কম। পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়া এবং আমদানি নির্ভর পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে বাজারের এই পরিস্থিতি।
কাঁচা মরিচের দাম বৃদ্ধির কারণ ব্যাখ্যা করে বাংলাদেশ কাঁচামাল আড়ত মালিক সমিতির সভাপতি মো. ইমরান মাস্টার বেনারকে বলেন, “চাহিদার তুলনায় সরবরাহ একেবারেই কম। চাহিদা ও সরবরাহে ব্যবধান থাকলে দাম বাড়বে।”
যদি স্টোরেজের ব্যবস্থা থাকত তাহলে বলা যেত, সিন্ডিকেট করছে কিন্তু এটি তো পচনশীল পণ্য। সিন্ডিকেট করার সুযোগ নেই।
খুচরা পর্যায়ে কেজি ৪০০ টাকা হওয়ার যুক্তি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “এর কারণ আমরাও বুঝতে পারছি না।”
বাংলাদেশ পাইকারি গরম মসলা ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি এনায়েত উল্লাহ বলেন, বিশ্ববাজারে মসলা জাতীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি ও ডলারের বিপরীতে বেশি টাকা খরচ হওয়ায় (টাকার অবমূল্যায়ন) স্থানীয় বাজারে দাম বেড়েছে।
বেনারকে তিনি বলেন, “আগে এক মেট্রিক টন জিরা আমদানি হতো দুই হাজার ডলারে, এখন ৭ হাজার ডলার হয়ে গেছে।”
সিন্ডিকেটের সুযোগ নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, “যে কেউ চাইলেই আমদানি করতে পারে, সুযোগ আছে। তাহলে সিন্ডিকেটের সুযোগ কোথায়!”
সংসদে সমালোচনার মুখে বাণিজ্যমন্ত্রী
দেশের পণ্য মূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতির কারণে গত সোমবার সংসদ অধিবেশনে বাণিজ্যমন্ত্রীর সমালোচনা করেছেন সংসদের বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যরা। কেউ কেউ তাঁর পদত্যাগও চেয়েছেন।
গণফোরামের সংসদ সদস্য মোকাব্বির খান বলেন, “বর্তমান সরকারের সবচেয়ে ব্যর্থ মন্ত্রণালয় হচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাজারে গেলে মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এতটাই ব্যর্থ যে, এটিকে মানুষ সিন্ডিকেটবান্ধব মন্ত্রণালয় বলে।”
তিনি বলেন, “অনেকে সংসদে বলেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী এর সঙ্গে জড়িত। এত কিছুর পরও আপনি কেন পদত্যাগ করেন না।”
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, “বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি ছিল ছয় শতাংশ, যা এখন সম্ভবত ১০ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি মানুষের আয় খেয়ে ফেলছে।”
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান বলেন, “শিল্প প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, বাজারে গিয়ে মানুষ কাঁদছে, তার একমাত্র কারণ সিন্ডিকেট।”
“শুধু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ওপর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির দায় চাপালে হবে না,” যোগ করেন তিনি।
প্রসঙ্গত, মূল্যস্ফীতির তথ্য উঠে আসছে সরকারের হিসাবেও। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, গত মে মাসে দেশে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ, যা বিগত ১১ বছরে সর্বোচ্চ।