আমিষের শেষ ভরসা ডিমও এখন স্বল্প আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে

রিয়াদ হোসেন
2023.08.11
ঢাকা
আমিষের শেষ ভরসা ডিমও এখন স্বল্প আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে ঢাকার শান্তিনগর বাজারে ডিম বিক্রি করছেন একজন বিক্রেতা। ১১ আগস্ট ২০২৩।
[বেনারনিউজ]

মাছের দাম নাগালের বাইরে চলে যাওয়ায় নারায়ণগঞ্জের জালকুড়ি এলাকার রাসেল গার্মেন্টসের শ্রমিক রহিমা আক্তার (৩০) আমিষের চাহিদা মেটাতে ডিমের ওপরেই ভরসা করতেন। কিন্তু গত এক বছরে দাম বেড়ে ডিমও তাঁর নাগালের বাইরে চলে গেছে।

সর্বশেষ গত দুই সপ্তাহ ধরে ডিমের দাম এতটাই বেড়েছে যে, মাসে নয় হাজার টাকার কিছু বেশি বেতন পাওয়া রহিমা ডিম কেনাও প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন।

“ডিমের হালি ৫৫ টাকা হয়েছে আরো পাঁচ দিন আগে। এখন ডিমও কিনতে পারছি না,” বেনারকে বলেন দুই সন্তানের মা রহিমা।

“মাছের বাজারেও এখন যাই না। মাংস বা মুরগির কথা অনেক আগেই ভুলে গেছি,” জানিয়ে তিনি বলেন, “কিছুদিন আগে আমার মেয়ে মাছ খেতে বায়না করেছিল। পরে বাজারে গিয়ে একটা পাঙাশ মাছ কিনেছি, তাও কেজি এখন ২২০ টাকা।”

প্রসঙ্গত পাঙাশ বাজারের সবচেয়ে সস্তা মাছ হিসেবে পরিচিত।

কেবল রহিমা নন, দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় রাজধানীসহ দেশব্যাপী স্বল্প আয়ের মানুষের কষ্ট বেড়েছে।

ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বেশ কয়েকজন ক্রেতা-বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কেবল ডিম নয়, গত দুই সপ্তাহে দেশি পেঁয়াজের কেজি ২০ টাকা বেড়ে ৮০ টাকায়, ব্রয়লার মুরগি কেজিতে ২০ টাকা, আলু ১০ টাকা বেড়েছে।

এর বাইরে গত এক বছর ধরে বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়েই চলছে। মাঝে কাঁচা মরিচের দাম ৮০০ টাকা হলেও তা এখন কমে আড়াইশ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।

দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলা লক্ষ্মীপুরের আবিদ হোসেন (৪২) স্থানীয় একটি ইলেকট্রনিক্স কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি। মাসে বেতন পান ১২ হাজার টাকা।

বেনারকে তিনি বলেন, “ছয় মাস আগেও ১২০ টাকায় এক ডজন ডিম পেতাম। এখন এক ডজনের দাম খুচরা বাজারে ১৭০ থেকে ১৭৫ টাকা। কেবল ডিমের দাম নয়, তেল, আলু, মুরগি–সবকিছুর দামই বেড়েছে।”

“বছর দুয়েক আগে গ্রামে মাসে ১২ হাজার টাকায় কোনোরকম চলতে পারতাম। ওই সময় আমার স্ত্রীর আয়ের টাকা থেকে কিছু সঞ্চয় হতো। এখন ২৫ হাজার টাকা দিয়েও মাস চলে না। কিন্তু আমার বেতন তো আর বাড়েনি।”

“সঞ্চয় করা তো সম্ভবই হচ্ছে না, এখন বরং দরকারি পণ্য কেনা কমাতে বাধ্য হচ্ছি। বাচ্চাদের জন্য অনেক দরকারি জিনিসও কিনতে পারছি না,” জানান আবিদ।

20230811193156_SONY7988-01.jpeg
ঢাকার হাতিরপুল বাজারে সবজি কিনছেন একজন ক্রেতা। ১১ আগস্ট ২০২৩। [বেনারনিউজ]

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে আমদানি নির্ভর তেল, চিনি, গম, জ্বালানি তেলসহ বেশকিছু পণ্যের মূল্য বাড়তে শুরু করে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে বেশকিছু পণ্যের দাম কমলেও স্থানীয় বাজারে কমছে না, উল্টো বাড়ছে।

এই পরিস্থিতির জন্য ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নকে মূলত দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা।

যদিও পণ্যের মূল বৃদ্ধির জন্য বড়ো বড়ো ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটকে দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।

ডিমের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় সামনে এসেছে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট প্রসঙ্গ।

দেশের প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ) জানিয়েছে, করপোরেট সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে ডিমের দাম আরও বাড়বে বলে তাদের আশঙ্কা।

বিপিএ সভাপতি সুমন হাওলাদার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এমন আশঙ্কার কথা জানিয়ে বলেন, ডিম ও মুরগির দাম বেড়ে বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টির অন্যতম কারণ প্রান্তিক পর্যায়ের অধিকাংশ ছোট ছোট খামার বন্ধ হয়ে যাওয়া। এ কারণে সরবরাহ–ঘাটতি তৈরি হয়েছে, যার প্রভাব পড়ছে বাজারে। আর এ খাতে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসায় সরকারি তদারকি না থাকায় পোলট্রি শিল্পে তাদের আধিপত্য বেড়েছে, যার খেসারত দিচ্ছে জনগণ।"

ডিমের দামে রেকর্ড, পেছনে কারসাজি

সরকারি বাজারমূল্য তদারককারী সংস্থার ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ওয়েবসাইট শুক্রবার খোলা যায়নি। সংস্থাটির ৬ আগস্টের তথ্য অনুযায়ী, ডিমের ডজন ছিল ১৫৫ টাকা।

শুক্রবার রাজধানীর ইব্রাহিমপুর বাজার সংলগ্ন বি বাড়িয়া স্টোরের দোকানকর্মী বেনারকে জানান, প্রতি ডজন ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৭৫ টাকা।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বেনারকে বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে এটাই ডিমের সর্বোচ্চ দাম। এর আগে গত বছর দাম উঠেছিল ১৫০ টাকা।

এটিকে কারসাজি উল্লেখ করে তিনি বলেন, “উৎপাদন কম, চাহিদা বেশি। কিন্তু এই পরিস্থিতি তো হঠাৎ করে হয়নি। এখানে কারসাজি আছে।”

ভোক্তাদেরও অভিযোগ এর পেছনে কারসাজি রয়েছে।

আবিদ হোসেন বলেন, “কারসাজির সঙ্গে জড়িতরা সরকারের মধ্যেই রয়েছে, যার জন্য তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।”

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান শুক্রবার বেনারকে বলেন, “কেউ না কেউ কারসাজি করছে।”

ডিমের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি ঠেকাতে বৃহস্পতিবার রাত থেকে মাঠে নেমেছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। রাজধানীর কাওরানবাজারে একজন পাইকারি ব্যবসায়ীকে বাড়তি দাম রাখার অভিযোগে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে বলে জানান এএইচএম সফিকুজ্জামান।

তিনি বলেন, শুক্রবারও ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালানো হয়।

20230811194242_SONY8109-01.jpeg
ঢাকার হাতিরপুল বাজারে মুরগি কেনাকাটা করছেন ক্রেতারা। ১১ আগস্ট ২০২৩। [বেনারনিউজ]

ভুগছে স্বল্প আয়ের মানুষ

স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য দিন দিনই জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। দেশের রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক খাতের ৪০ লাখ শ্রমিক ছাড়াও প্রাতিষ্ঠানিক অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক-কর্মচারীদের জন্য এ সময়টা বড্ড কঠিন।

পোশাক খাতে গত পাঁচ বছর আগে বেতন বাড়ার পর নতুন বেতন নির্ধারণ হয়নি। যদিও নতুন মজুরি বোর্ড গঠন করা হয়েছে।

“সংসার চালানো খুব কষ্ট হয়ে গেছে। আমার স্বামী নেই, দুইটা মেয়ে নিয়ে কষ্টে আছি। এই বেতনে আমিষের চিন্তাও করা যায় না,” বলেন রহিমা আক্তার।

মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ

সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র (বিবিএস) সর্বশেষ প্রকাশিত জুলাই মাসের তথ্য অনুযায়ী মূল্যস্ফীতি এখন ১০ শতাংশের কাছাকাছি। গত জুন মাসে এই মূল্যস্ফীতি ছিল আরো বেশি।

এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ শতাংশের উপরে, যা বিগত ১২ বছরে সর্বোচ্চ।

অবশ্য পণ্যমূল্য বৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের কষ্ট কমাতে সরকারের উদ্যোগ তুলে ধরে শুক্রবার বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সাংবাদিকদের বলেন, “টিসিবির মাধ্যমে স্বল্প মূল্যে খাদ্যপণ্য বিক্রয় করা হচ্ছে। সারা দেশে এক কোটি ফ্যামিলি কার্ডধারীদের মাঝে তেল, ডাল এবং চালসহ অন্যান্য পণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। সরকার বিশাল অংকের ভর্তুকি দিয়ে গরীব-অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।”

এক প্রশ্নের জবাবে টিপু মুনশি বলেন, “ডিম বা মুরগি অথবা পিঁয়াজ কিংবা কাঁচা মরিচের দাম বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট না। এগুলো দেখভালের দায়িত্ব অন্য দুটি মন্ত্রণালয়ের কাছে।”

“কিন্তু যেকোনো পণ্যের দাম বাড়লেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়,” বলেন তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।