সরকারের বেঁধে দেওয়া নিত্যপণ্যের দর মানছেন না ব্যবসায়ীরা
2023.09.18
ঢাকা
নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের উদ্যোগ কোনো কাজে আসছে না। চার দিন আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ডিম, পেঁয়াজ ও আলুর দর বেঁধে দিলেও ভোক্তাদের অভিযোগ, ব্যবসায়ীরা তা মানছেন না।
বাজার যাচাই করে ভোক্তাদের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। তিনটি পণ্য সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) দৈনন্দিন বাজার পর্যালোচনায়ও কোনো কোনো পণ্য নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে বিক্রির তথ্য উঠে এসেছে।
নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়তে থাকায় বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার গত বৃহস্পতিবার প্রতি পিস ডিমের দাম সর্বোচ্চ ১২ টাকা, দেশি পেঁয়াজ প্রতি কেজি সর্বোচ্চ ৬৫ টাকা ও আলু ৩৬ টাকায় নির্ধারণ করে দেয়।
এর পাশাপাশি বাজার নিয়ন্ত্রণে এসব পণ্য আমদানিরও উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর অংশ হিসেবে গত রোববার চারটি প্রতিষ্ঠানকে চার কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছে।
“আমদানি করা ডিমও সরকার নির্ধারিত ১২ টাকা পিস দরে বিক্রি করতে হবে,” বলে সোমবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের জানান বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব তপন কান্তি ঘোষ।
দেশে প্রতিদিন চার কোটি ডিম প্রয়োজন হয় জানিয়ে তিনি বলেন, “দাম কমলে আর আমদানির প্রয়োজন হবে না। অন্যথায় আবার আমদানির অনুমতি দেওয়া হবে।”
আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে আমদানির ডিম দেশে আসা শুরু হবে বলে জানিয়েছেন আমদানিকারকরা।
ডিম আমদানির ফলে বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে জানিয়ে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহসভাপতি এস এম নাজের হোসেন বেনারকে বলেন, “বাজারে আমদানিকৃত ডিম আসতে শুরু করলে সিন্ডিকেটে আঘাত পড়বে। দাম কমে আসবে।”
এই দাবি আরও আগেই জানানো হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “ভারতে প্রতিটি ডিমের দাম ছয় টাকা। সেখানে কি ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব পড়েনি? তাহলে এখানে কেন এত বেশি দামে বিক্রি হবে?”
নির্ধারিত দামে পণ্য মিলছে না
ভোক্তারা জানিয়েছেন, সরকার নির্ধারিত দামে কোথাও এসব পণ্য পাওয়া যাচ্ছে না।
রাজধানীর মিরপুরের পল্লবী এলাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন সাইফুর রহমান। তিনি বেনারকে বলেন, “সরকারের নির্ধারিত দামে কোনো পণ্যই বিক্রি হচ্ছে না। গতকালও আলু কিনেছি ৫০ টাকা কেজি দরে। দেশি পেঁয়াজের দাম বেশি, এ জন্য আমদানি করা পেঁয়াজ কিনছি।”
এই প্রতিবেদক রাজধানীর শেওড়াপাড়া, ইব্রাহিমপুর ও আগারগাঁও এলাকার তিনটি দোকান যাচাই করে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বাড়তি দামে বিক্রি হতে দেখেছেন।
আগারগাঁওয়ের জনতা হাউজিং এলাকার চাঁদপুর বাবা-মা জেনারেল স্টোরে দাম জানতে চাইলে দোকানি প্রতি হালি ডিম ৫০ টাকা (প্রতিটি ১২.৫০ টাকা), প্রতি কেজি পেঁয়াজ ও আলু যথাক্রমে ৯০ ও ৫০ টাকা দাম চান।
সরকার দাম কমিয়েছে, তবুও বাড়তি দর কেন জানতে চাইলে বিক্রয়কর্মী বেনারকে বলেন, “দাম কমালে কী হবে, কম দামে কিনতে তো পারতে হবে।”
তাঁর দাবি, প্রতিটি ডিম কেনা পড়ে ১২ টাকা। কোথায় থেকে বা কার কাছ থেকে কেনা হয়েছে জানতে চাইলে জবাব দিতে পারেননি তিনি।
ভোজ্য তেল, চিনি ও এলপি গ্যাসের দাম নির্ধারণ করে দিচ্ছে সরকার। ভোক্তাদের অভিযোগ, এগুলোও সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি হচ্ছে না।
দোকানিরা কিনছেন বেশি দামে
খুচরা দাম নির্ধারণের সময় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় হিমাগার পর্যায়ে প্রতি কেজি আলুর দাম ২৬ টাকা নির্ধারণ করেছিলে। ওই দিন বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বেনারকে বলেছিলেন, “এই দামে কোল্ড স্টোরেজ মালিকদের পক্ষে বিক্রি করা সম্ভব।”
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযানে দেখা গেছে, হিমাগার মালিকরা ওই দাম মানছেন না। প্রতি কেজি আলু কোল্ড স্টোরেজ থেকে ৩৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে সোমবার মোস্তফা আজাদ চৌধুরীর মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। এসএমএস পাঠানো হলে এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তার জবাব আসেনি।
রাজধানীর কারওয়ানবাজারের পেঁয়াজের আড়তদার আশরাফ হোসেন বেনারকে বলেন, “প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ পাবনা থেকে আমাদের কেনা পড়ে ৭০ টাকা আর বিক্রি করছি ৭৫ টাকায়। তাতেও আমাদের লোকসান হচ্ছে। তবুও আতঙ্কে আছি।”
সরকারি দর অনুযায়ী, প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ভোক্তা পর্যায়ে ৬৫ টাকা হওয়ার কথা।
অবশ্য কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক প্রণব কুমার বেনারকে বলেন, “তিনটি স্তরে প্রত্যেকের কমপক্ষে ১০ শতাংশ মুনাফা ধরেই দাম নির্ধারণ করা হয়েছে।”
তিন দিনে ৪৫৭ প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা
সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি নিশ্চিত করতে গত শনিবার থেকে অভিযানে নেমেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। অতিরিক্ত দামে পণ্য বিক্রি করায় গত তিন দিনে ৪৫৭টি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ১৬ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বেনারকে বলেন, “সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি না হওয়া পর্যন্ত আমাদের অভিযান চলবে।”
ভোক্তারা আরও জানান, অভিযান শুরু হলে ব্যবসায়ীরা দাম কিছুটা কম রাখেন। তবে অভিযানকারী দল চলে যাওয়ার পরে আবার পুরোনো দামে বিক্রি করেন। তাঁদের ভাষ্য, জরিমানার এই অর্থ ব্যবসায়ীরা ভোক্তার কাছ থেকেই আদায় করছেন।
নাটোরের সিংড়া উপজেলার বাসিন্দা মতিউর রহমান ঢাকায় রিকশা চালান। তিনি বেনারকে বলেন, “জরিমানা নিচ্ছে, এটা তো ভুল! কেননা এটা তো ব্যবসায়ীরা পরে আমাদের কাছ থেকে আদায় করে।”
আমদানির ডিম প্রতিটি ১০ টাকায় বিক্রি সম্ভব
যে চারটি প্রতিষ্ঠানকে ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে, তাদের একটি টাইগার ট্রেডিং। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী সাইফুর রহমান বেনারকে জানান, অনুমতি পাবার পর তাঁরা আমদানির প্রক্রিয়া শুরু করেছেন।
“আশা করছি, আগামী চার থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে ডিম দেশে আনতে পারব,” বলেন তিনি।
আমদানি করা ডিম সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি করা সম্ভব হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এর চেয়েও কম দামে বিক্রি করতে পারব। আমরা আশা করছি, ১০ টাকা দামে বিক্রি করা সম্ভব হবে।”