দেড় মাসেও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নিহতদের হিসাব মেলেনি
2024.09.23
ঢাকা
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে কত মানুষ মারা গেছেন তা গত দেড় মাসেও নিশ্চিত করতে পারেনি সরকার। এরই মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে ১ হাজার ৪২৩ জনের মৃত্যুর খবর প্রকাশ করা হয়েছে। যা সরকারি তথ্যের দ্বিগুণেরও বেশি।
সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে জুলাইর মাঝামাঝি থেকে গত ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই আন্দোলনে মৃতের সংখ্যা ছিল ৬৩১ জন। এটাই সরকারের সর্বশেষ আনুষ্ঠানিক তথ্য। যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র, আইন ও তথ্যসহ একাধিক উপদেষ্টা বলে আসছেন, এই আন্দোলনে নিহতের সংখ্যা প্রায় এক হাজার। তবে সবার নাম ঠিকানা সরকারের কাছে নেই।
এদিকে জুলাইর গণ আন্দোলনের সময় আহত অনেকেই দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন থাকার পরে এখনো মৃত্যুবরণ করছেন, যাদের সঠিক হিসাব কারো কাছে নেই।
সর্বশেষ সোমবার ৪৯ দিন লড়াইয়ের পর রাজধানীর আগারগাঁওয়ের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র জুনায়েদ ইসলাম রাতুল।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বোন ও দুলাভাইয়ের সঙ্গে যোগ দিয়ে ৫ আগস্ট বগুড়ায় গুলিবিদ্ধ হয় রাতুল। তার মৃত্যুর সংবাদ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন রাতুলের বোন জেরিন সুলতানা।
জেরিন বলেন, “মায়ের নিষেধ সত্ত্বেও ৫ আগস্ট সকালের নাস্তা না করেই আমরা আন্দোলনে গিয়েছিলাম। এক সময় আমরা মিছিল নিয়ে বগুড়া সদর থানার কাছে ঝাউতলা পৌঁছাই। পুলিশ মিছিলে গুলি চালালে রাতুল আহত হয়।”
“চারটি গুলি রাতুলের মাথায় লাগে। একটি গুলি রাতুলের বাম চোখ দিয়ে মাথায় ঢুকেছে,” জানিয়ে জেরিন বলেন, প্রাথমিকভাবে রাতুলকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে ভর্তি করলে চিকিৎসকেরা তাকে ঢাকায় পাঠান।
তিনি বলেন, ঢাকায় অস্ত্রোপচার করে রাতুলের মস্তিষ্কের ভেতর থেকে একটি বুলেট বের করেন চিকিৎসকরা। এরপর রাতুলকে কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস দেওয়া হয়। “কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে বাঁচল না।”
এমন মৃত্যুর খবর এখন নিয়মিত। অসংখ্য আহত ব্যক্তি এখনও চিকিৎসাধীন থাকায় হাসপাতালগুলো থেকে নিয়মিত মৃত্যুর খবর আসছে।
আন্দোলনকারীদের দাবি, মৃতের সংখ্যা ১৪২৩
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্বাস্থ্য বিষয়ক কেন্দ্রীয় উপ-কমিটি গত শুক্রবার রাতে জানিয়েছে, এই আন্দোলনে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৪২৩ জনের মৃত্যুর সংবাদ নিশ্চিত হয়েছে তারা।
শুক্রবার রাতে ফেসবুকে একটি ভিডিও পোস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্বাস্থ্য বিষয়ক কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সদস্য সচিব তরিকুল ইসলাম বলেন, জুলাই বিপ্লবে শহিদের সংখ্যা ১ হাজার ৪২৩ জন। তবে এই সংখ্যাটা কম-বেশি হতে পারে।
“আহতদের নিয়ে কাজ করাটা খুব দুরূহ। কারণ, এই সংখ্যাটা বিপুল। আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত ২২ হাজার আহত মানুষের তালিকা আছে। তবে এই সংখ্যাও সংযোজন-বিয়োজন হবে,” বলেন তরিকুল।
তিনি জানান, আন্দোলনে গিয়ে পঙ্গু বা অঙ্গহানি হয়েছে এমন মানুষের সংখ্যা ৫৮৭ জন। গুলি লেগে আংশিক বা সম্পূর্ণ দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন ৬৮৫ জন। তাঁদের মধ্যে ৯২ জন দুই চোখেই গুলি খেয়েছেন বা দুই চোখই নষ্ট হয়ে গেছে।
তথ্য সংগ্রহের উপায় সম্পর্কে জানতে চাইলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্বাস্থ্য বিষয়ক কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির আহ্বায়ক নাহিদা বুশরা বেনারকে বলেন, গত কয়েক সপ্তাহে স্বেচ্ছাসেবকরা সারাদেশের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছেন।
“আমরা তথ্য সংগ্রহ করেছি এবং ক্রস-চেক সম্পন্ন করেছি। পারিবারিক বিস্তারিত তথ্য ছাড়াই আমাদের তালিকায় এখনও অনেক নাম রয়েছে,” যোগ করেন বুশরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বিভিন্ন এনজিও এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাছ থেকে এই কমিটি সহায়তা নিয়েছে বলে তিনি জানান।
“আমরা খুব আশাবাদী যে আমাদের তালিকায় কোনো ‘ডাবল কাউন্ট’ নেই এবং কোনও বড়ো ত্রুটি নেই, তবে আমরা তালিকা প্রকাশ করার আগে সমস্ত তথ্য পুনরায় পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি,” বলেন নাহিদা বুশরা।
‘গণনার বাইরে বিশাল সংখ্যা’
এদিকে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব মুহাম্মদ হুমায়ুন কবিরের নেতৃত্বে একটি কমিটি আন্দোলনে নিহতের সংখ্যা নিরূপণে কাজ করছে।
হুমায়ুন কবির বেনারকে বলেন, “আমরা প্রাথমিক এবং অফিসিয়াল তথ্যের ভিত্তিতে প্রাথমিকভাবে মৃত্যুর সংখ্যা ৬৩০ হিসাবে প্রকাশ করেছি, প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবে আমাদের গণনার বাইরে একটি বিশাল সংখ্যা রয়ে গেছে।”
এ প্রসঙ্গে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নিহতদের সংখ্যা নির্ধারণের যে কাজটি করছে তা “সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু নিঃসন্দেহে কাজটা করা কঠিন। শিক্ষার্থীদের পক্ষে অনেক তথ্য পাওয়াও সম্ভব নয়।”
তিনি বলেন, “বেশ কিছু মানুষ নিখোঁজ রয়েছেন। তারা বেঁচে আছেন কি না তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। অনেককে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে। সেগুলো হিসেবে আনা যায়নি।”
"অনেকগুলো সংস্থা একসাথে মিলে কাজটি করলে এই আন্দোলনে হতাহতদের সঠিক চিত্র পাওয়া যেত,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, যত দ্রুত সম্ভব জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ এই কাজটি শেষ হওয়া উচিত।
এ ধরনের বড়ো আন্দোলনের সময় হতাহতদের সঠিক সংখ্যা পাওয়া বেশ কঠিন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
কারণ ব্যাখ্যা করে সাবেক সচিব হুমায়ুন কবির বলেন, “আন্দোলনের সময় পরিস্থিতি খুবই অস্বাভাবিক ছিল। অনেক হাসপাতাল মৃত ব্যক্তির কোনো বিবরণ রাখেনি, অনেকে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা না দিয়ে ফেরত পাঠায় এবং অনেকে হয়রানি এড়াতে তথ্য সংরক্ষণ না করে চিকিৎসা প্রদান করে।”
তিনি বলেন, “অনেক হাসপাতাল ভয়ের কারণে চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য মুছে ফেলেছে এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা আড়াল করতে মৃত ব্যক্তির তথ্য মুছে দিয়েছে কিছু কিছু হাসপাতালে।”
শিক্ষার্থীদের অনুসন্ধান সম্পর্কে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এম এ আকমল হোসেন আজাদ বেনারকে বলেন, শিক্ষার্থীরা তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী তথ্য সংগ্রহ করেছে।
“আন্দোলনের সময় যারা নিহত হয়েছেন তাদের একটি বিস্তারিত তালিকা আমরাও তৈরি করছি। খুব শীঘ্রই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে তালিকাটি প্রকাশ করা হবে,” বলেন আকমল।
এই পরিস্থিতিতে গণঅভ্যুত্থানে গুরুতর আহতদের উন্নত চিকিৎসা সেবা দিতে রোববার চীনের একটি জাতীয় জরুরি মেডিকেল টিম ঢাকায় এসেছে। সোমবার থেকে তারা চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু করেছে বলে জানিয়েছে ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাস।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ১ জুলাই থেকে আন্দোলন শুরু হলেও ১৬ জুলাই তা সহিংস রূপ নেয়। পরবর্তীতে ছাত্র আন্দোলন ছাত্র-জনতার আন্দোলনে রূপ নেয় এবং অবশেষে ৫ আগস্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পালিয়ে যান।
এর মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার প্রায় ১৬ বছরের নিরবচ্ছিন্ন ক্ষমতার অবসান ঘটে।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে অয়ন আমান।