অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান ড. ইউনূস
2024.08.06
ঢাকা
শেখ হাসিনা সরকার পতনের এক দিন পর বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে মনোনীত হয়েছেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন মঙ্গলবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৩ প্রতিনিধি ও সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকের-উজ-জামানের সাথে দীর্ঘ বৈঠকের পর এই সিদ্ধান্ত হয়।
বৈঠকের পর রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব জয়নাল আবেদীন বেনারকে বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের “বাকি সদস্যদের নাম ও সরকারের মেয়াদ” পরবর্তীতে অন্যান্য অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত করা হবে।
এর আগে নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস (৮৪) আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দেওয়ার প্রস্তাবে সম্মতি দিয়ে দেশে ফেরারা কথা জানিয়েছেন।
বর্তমানে দেশের বাইরে অবস্থান করা অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনূস মঙ্গলবার মধ্যরাতে বা বুধবার ঢাকায় পৌঁছাবেন বলে স্থানীয় গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন ইউনূস সেন্টারের মুখপাত্র লামিয়া মোরশেদ।
“অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্ব দেবার জন্য আন্দোলনকারীরা আমাকে চাওয়ায় এবং আমার ওপর আস্থা রাখায় আমি সম্মানিত বোধ করছি,” বার্তাসংস্থা এএফপিকে বলেন ড. ইউনূস।
তিনি বলেন, “দেশের জন্য, দেশের মানুষের সাহসিকতার জন্য যদি বাংলাদেশে আমাকে কিছু করতে হয়, তবে আমি তা করব।”
সংসদ ভেঙে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি
মঙ্গলবার রাষ্ট্রপতি গত ৭ জানুয়ারির বিতর্কিত সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত দ্বাদশ সংসদ ভেঙে দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের উদ্যোগ নেন। যদিও সংবিধানে এ ধরনের সরকারের কোনো বিধান নেই।
অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের বর্জনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত চলতি বছরের জানুয়ারিতে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সংসদ গঠন করে। ওই সংসদে আওয়ামী লীগের বাইরের সংসদ সদস্যরাও তাঁর দলের নেতা হয়েও স্বতন্ত্র হিসেবে জয় লাভ করেছিলেন।
মঙ্গলবার বঙ্গভবনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধান, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে আলোচনার পর সংসদ ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।”
সংসদ ভেঙ্গে যাওয়ায় সংবিধানের বাইরে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করার বিকল্প নেই বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
“রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দিয়েছেন। পরিবর্তে, তিনি পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য একটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন গঠন করতে পারতেন এবং তারপর আইনসভা ভেঙে দিতে পারতেন। সংবিধান ইতিমধ্যে লঙ্ঘন হয়ে গেছে,” বেনারকে বলেন, রাজনৈতিক ভাষ্যকার ও বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একজন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। এটি একটি ভিন্নরকম বা বিশেষ পরিস্থিতি। একটি নতুন সংসদ গঠিত হলে এই কাজগুলো অবশ্যই বৈধ করতে হবে।
তিনি বলেন, “১৯৯১ সালে বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদের ঘটনার মতো অন্তর্বর্তী সরকারের যাবতীয় কার্যক্রমকে বৈধতা দিতে পরবর্তী সংসদকে অবশ্যই সংবিধান সংশোধন করতে হবে।”
খালেদা জিয়া মুক্ত
রাষ্ট্রপতি মোঃ শাহাবুদ্দিন মঙ্গলবার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাজা মওকুফ করে তাঁকে মুক্তি দিয়েছেন।
খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার একদিনের মাথায় এই ঘটনা ঘটল।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি গেজেটে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি দুটি মামলায় প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া শাস্তি থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন এবং তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
মঙ্গলবার আইন মন্ত্রণালয়ের জারি করা এক গেজেট প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ঢাকার বিশেষ আদালত এবং পরে হাইকোর্ট বেঞ্চ কর্তৃক প্রদত্ত খালেদা জিয়ার সাজা সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদের অধীনে রাষ্ট্রপতি বাতিল করেছেন।
প্রসঙ্গত, সংবিধানের ওই অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রপতি যে কোনো আদালতের দেয়া দণ্ড মার্জনা, স্থগিত বা হ্রাস করতে পারেন।
“খালেদা জিয়ার মুক্তি বাংলাদেশের মানুষের বড়ো অর্জন। গণতন্ত্রকামী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্যে সরকার তাঁকে (খালেদাকে) মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছে,” বেনারকে বলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা ইসলাম।
আড়াই হাজার বন্দি মুক্ত
এদিকে খালেদা ছাড়া বিএনপি অন্যান্য বিরোধী দল এবং আন্দোলনকারী ছাত্রদের মধ্যে থেকে গত ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্টের মধ্যে গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তি দেওয়ার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে প্রায় আড়াই হাজার মানুষকে মুক্তি দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন আদালতের কর্মকর্তারা।
সোমবার আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন। তার কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনের বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব ছাত্র-জনতা গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যে ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। ভারতীয় গণমাধ্যমের তথ্যমতে, বর্তমানে শেখ হাসিনা ভারতে রয়েছেন।
মঙ্গলবার ভারতের গণমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও কিছুদিন ভারতে থাকবেন কারণ যুক্তরাজ্যে আশ্রয় নেওয়ার তার পরিকল্পনাটি কিছুটা জটিলতার মধ্যে পড়েছে।
আইজিপি বদল, সেনাবাহিনীতেও রদবদল
মঙ্গলবার দিবাগত রাতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে।
অন্য দিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে পুলিশের ট্রাফিক অ্যান্ড ড্রাইভিং স্কুল এর কমান্ড্যান্ট অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক ময়নুল ইসলামকে পুলিশের নতুন মহাপরিদর্শক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
এর আগে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানায়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শীর্ষ পদে ব্যাপক রদবদল হয়েছে।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নে (র্যাব) কর্মরত থাকা অবস্থায় ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে অভিযোগ থাকা মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানকে চাকরি হতে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
জিয়াউল জাতীয় টেলিযোগাযোগ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের মহাপরিচালক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ায় মহাপরিচালকের শূন্য পদে নিয়োগ পেয়েছেন মেজর জেনারেল আ স ম রিদওয়ানুর রহমান।
জিয়ার বিরুদ্ধে ফোনে আড়িপাতা এবং গুপ্তহত্যায় শেখ হাসিনা সরকারকে মদত দেওয়ার সরাসরি অভিযোগ তুলেছিলেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও বিরোধী নেতারা।
রদবদল হওয়া তালিকায় সেনাবাহিনীর কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা রয়েছেন।
ভেঙে পড়েছে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা
শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার একদিন পর, মঙ্গলবার বাংলাদেশ হয়ে পড়েছে আইনশৃঙ্খলা শূন্য। কার্যত কোনো সরকার না থাকা এবং হামলার মুখে থানা থেকে পুলিশ সদস্যরা পালিয়ে যাওয়ায় এদিন কোথাও চোখে পড়েনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি।
এদিন সড়কগুলোতে কোনো ট্র্যাফিক পুলিশকে দেখা যায়নি। কোনো কোনো স্থানে ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজ করতে দেখা গেছে শিক্ষার্থীদের।
তার আগে সোমবার শেখ হাসিনার পতনের পর বিক্ষুব্ধ জনতা দেশের প্রায় সব থানায় হামলা চালায়। এতে বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য মারাও যান।
সোমবার সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কমপক্ষে ১০৮ জন মানুষের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হয়েছে বেনার।
এই ছাত্র আন্দোলনকে ঘিরে বাংলাদেশে ৩৬ দিনে মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় চারশো। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজন পুলিশ রয়েছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় বিভিন্ন থানায় দুর্বৃত্তরা হামলা করেছে।
এই পরিস্থিতিতে সাধারণ পুলিশ সদস্যরা মঙ্গলবার দায়িত্ব পালন থেকে বিরত ছিলেন।
এই পরিস্থিতিতে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর জারি করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সারা দেশের সব থানায় তাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
নিউইয়র্কে নিয়মিত ব্রিফিংয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব উপ-মুখপাত্র ফারহান হক বলেছেন, তাঁরা বাংলাদেশের পরিস্থিতি খুব নিবিড়ভাবে দেখছেন এবং শান্ত ও সংযমের আহ্বান অব্যাহত রেখেছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে এবং বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী যেকোনো রূপান্তর পরিচালনার আহ্বান জানিয়েছে।
সোমবার ওয়াশিংটনে ব্রিফিংয়ে স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেছেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পদ থেকে পদত্যাগ করে বাংলাদেশ ত্যাগ করায় তাঁরা পরিস্থিতি সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করছেন।”
“যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জনগণের পাশে আছে। আমরা সব পক্ষকে আরও সহিংসতা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাই।”
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সহিংসতার বিষয়ে জাতিসংঘের নেতৃত্বে পূর্ণাঙ্গ ও স্বাধীন তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাজ্য।
“বাংলাদেশের জনগণ গত কয়েক সপ্তাহের ঘটনা নিয়ে জাতিসংঘের নেতৃত্বে পূর্ণাঙ্গ ও স্বাধীন তদন্তের দাবি রাখে,” মঙ্গলবার যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র সচিব ডেভিড ল্যামি বলেন।
গণবিক্ষোভের পর শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকরা সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ওপর হামলার খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।