অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব নিয়ে ড. ইউনূস: সব অপরাধের বিচার হবে
2024.08.08
ঢাকা
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে শপথ নিয়ে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, সব অপরাধের বিচার হবে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের তিন দিনের মাথায় বৃহস্পতিবার শপথ নেন তিনি।
ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন ১৭ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদের মধ্যে তিনিসহ ১৪ জন এই অনুষ্ঠানে শপথ নেন। বাকি তিনজন ঢাকার বাইরে থাকায় শপথ নিতে পারেননি।
রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন ঢাকার বঙ্গভবনে শপথ অনুষ্ঠানের অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন।
বিশেষ এক পরিস্থিতিতে গঠিত নতুন এই সরকারে মেয়াদ এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টারা সবাই মন্ত্রীর পদমর্যাদা সম্পন্ন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই সংগঠক নাহিদ ইসলাম এবং আসিফ মাহমুদ স্থান পেয়েছেন এই সরকারে।
শপথ নেয়া অন্য উপদেষ্টারা হলেন; সালেহ উদ্দিন আহমেদ, আসিফ নজরুল, আদিলুর রহমান খান, এ এফ হাসান আরিফ, তৌহিদ হোসেন, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, শারমিন মুর্শিদ, এম সাখাওয়াত হোসেন, আ ফ ম খালিদ হাসান, ফরিদা আখতার এবং নূরজাহান বেগম।
শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনাকারী মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোঃ মাহবুব হোসেন জানান, ফারুক-ই-আজম, সুপ্রদীপ চাকমা ও বিধান রঞ্জন রায়ের শপথ পরবর্তীতে অনুষ্ঠিত হবে।
সব অপরাধের বিচার হবে: ড. ইউনূস
বঙ্গভবনে শপথ অনুষ্ঠান শেষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ইউনূস বলেছেন, সরকারি প্রতিষ্ঠান দিয়ে স্বৈরাচার সরকার নিজেদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছিল। আমরা এসব প্রতিষ্ঠানের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনব।
“যারা অপরাধ করেছে, তাদের আইনের মাধ্যমে বিচারের আওতায় এনে শিগগিরই উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হবে। …সব অপরাধীর বিচার হবে,” বলেন তিনি।
সবাইকে নির্ভয়ে ও আনন্দচিত্তে নিজ নিজ কর্মস্থলে নিজের জায়গা থেকে সামর্থ্য নিয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, দেশের সব মানুষকে স্বাধীন, নির্ভয়, নির্ভার থাকার নিশ্চয়তা দেওয়ার জন্য ছাত্ররা শহীদ হয়েছেন। তারা গণঅভ্যুত্থান করেছেন। এই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সৃষ্ট সরকার সবার।
“নিষ্ঠুর স্বৈরাচার সরকার দূর হয়ে গেছে। কাল সূর্য উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে গণতন্ত্রের, সুবিচারের, মানবাধিকারের, নির্ভয়ে মতপ্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য, সবার স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন ধারণের সুযোগ প্রদানের জন্য সচেষ্ট সরকারের বলিষ্ঠ সান্নিধ্য ও সহমর্মিতা দলমত নির্বিশেষে সবাই উপভোগ করবে-এটিই আমাদের লক্ষ্য। আপনারা আমাদের লক্ষ্য পূরণে সহযোগিতা করুন,” বলেন ইউনূস।
“কোনো সময়সীমা ছাড়াই” তাঁরা সরকারের দায়িত্ব নিয়েছেন বলে শপথ শেষে সাংবাদিকদের জানান আসিফ মাহমুদ। এছাড়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার “জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিতে” কাজ করবে বলে জানান নাহিদ ইসলাম।
“গত কয়েকটি নির্বাচনে জনগণ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আমরা জনগণের ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারে জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঠিক করতে কাজ করব। তারপর নির্বাচন হবে,” বলেন তিনি।
বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি এবং বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকলেও শপথ অনুষ্ঠানে দেখা যায়নি আওয়ামী লীগের কোনো প্রতিনিধিকে।
মূল চ্যালেঞ্জ ‘আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা’
বৃহস্পতিবার বঙ্গভবনে শপথ নেবার পর তাৎক্ষণিকভাবে বেনারের কাছে নতুন সরকারের মূল চ্যালেঞ্জ ও লক্ষ্য সম্পর্কে নিজেদের মতামত ব্যক্ত করেছেন উপদেষ্টা পরিষদের সাতজন সদস্য। তাঁদের সকলের মতে, নতুন সরকারের সামনে মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দেশে আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা।
“বাংলাদেশকে পুনর্গঠনের শপথ নিয়েই আমরা এই সরকার গঠন করেছি। যে শহীদদের রক্তর বিনিময়ে বাংলাদেশ পেয়েছি সেখানে, শান্তিশৃঙ্খলা এবং মানুষের অধিকার, জীবনের নিরাপত্তা, সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করাই হবে আমাদের প্রধান লক্ষ্য,” বেনারকে বলেন উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম তরুণ সদস্য মো. নাহিদ ইসলাম।
দেশে “আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা,” অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম পদক্ষেপ বলে বেনারকে জানান উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। তাঁর সাথে একমত পোষণ করে সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এর পাশাপাশি, “দেশের মন্থর অর্থনৈতিকে উজ্জীবিত করা” ও “শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে চালু করা,” হবে সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য।
বাংলাদেশের চলমান শাসন ব্যবস্থাকে ‘বিনষ্ট’ হিসেবে আখ্যায়িত করে উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ বলেন, “প্রথম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে একটা বিনষ্ট জিনিসকে আবার সুপ্রতিষ্ঠিত করা।”
আদিলুর রহমান খানের মতে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে “দায়িত্ব নেয়টা হচ্ছে রক্তের ওপরে দাঁড়িয়ে দায়িত্ব পালন।”
এই মুহূর্তে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা প্রথম কাজ উল্লেখ করে তিনি বলেন, “যারা জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তাদের আইনের সামনে আনা দরকার। পাশাপাশি, যারা পরিস্থিতির শিকার হয়েছে তাদের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করাও অন্যতম বড়ো দায়িত্ব।”
গত কয়েক সপ্তার সহিংসতার প্রসঙ্গ ধরে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বেনারকে বলেন, “এরকম বর্বরতম হত্যাকাণ্ড ও সহিংসতার বিচার যদি নিশ্চিত করা না যায় তাহলে আমরা আর আইনের শাসনের কথা কেমন করে বলব?”
এর পাশাপাশি, দেশে সুশাসন, জবাবদিহিতা, মানবাধিকার নিশ্চিত করাও অন্তর্বর্তী সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।
“এই সরকারের সবচে নতুন বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানে ২৫ থেকে ৮৫ বছর বয়স পর্যন্ত সবার অংশগ্রহণ রয়েছে, সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব রয়েছে,” উল্লেখ করে উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম তরুণ সদস্য আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বেনারকে বলেন, এই সরকার “একটি নতুন বাংলাদেশ গড়তে পারবে।”
“ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই যে ডায়নামিক একটা সরকার আমরা গঠন করতে পেরেছি, এটি বাংলাদেশকে একটি নতুন বাংলাদেশ হিসেবে আবির্ভূত করতে সহযোগিতা করবে,” বলেন তিনি।
নতুন সরকারকে মোদির শুভেচ্ছা
প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ গ্রহণের পরপরই ড. ইউনূসকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে এক বার্তায় তিনি বলেন, “আমরা আশা করি হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করে বাংলাদেশে দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় দ্রুত ফিরে আসবে।”
শান্তি, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের জন্য দুই দেশের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
হাসিনার গন্তব্য জানে না ভারত
এদিকে ক্ষমতা ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেওয়া সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোন দেশে আশ্রয় পেতে চলেছেন, তা এখনো জানে না ভারত সরকার।
বৃহস্পতিবার নিয়মিত ব্রিফিংয়ে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, “তাঁর (হাসিনা) পরিকল্পনা কী, সে বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো খবর নেই। তিনি কী করবেন, তাঁকেই ঠিক করতে হবে।”
সরকারের সঙ্গে কাজ করবে যুক্তরাষ্ট্র
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে কাজ করতে যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তুত বলে জানিয়েছে দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তর।
নতুন এই সরকার শপথ নেওয়ার আগেই ওয়াশিংটনের স্থানীয় সময় বুধবার এক নিয়মিত ব্রিফিংয়ে এ কথা বলেন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেনের বরাতে তিনি বলেন, “অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেসব সিদ্ধান্ত নেবে, সেগুলোতে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, আইনের শাসন ও জনগণের ইচ্ছার প্রতি সম্মান দেখাতে হবে।”
কাজে যোগ দেয়নি পুলিশ
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে কর্মবিরতিতে থাকা পুলিশ সদস্যদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিজ নিজ কার্যালয়ে যোগ দিতে বুধবার পুলিশ প্রধান নির্দেশ দিলেও বৃহস্পতিবার কাজে ফেরেননি বেশির ভাগ পুলিশ সদস্য।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার রোষানলে পুলিশ সদস্য হত্যা ও বেশিরভাগ থানা ব্যাপকভাবে ভাঙচুর হওয়ার পর চাকরিতে নানা বঞ্চনার কথা তুলে ধরে কর্মবিরতিতে যান পুলিশ সদস্যরা।
দায়িত্ব নেওয়ার পর বুধবার পুলিশের নবনিযুক্ত মহাপরিদর্শক মো. ময়নুল ইসলাম বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার মধ্যে সকল পুলিশ সদস্যকে কর্মক্ষেত্রে যোগ দিতে নির্দেশ দেন।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মুখপাত্র মোঃ ফারুক হোসেন বৃহস্পতিবার বেনারকে জানান, ঢাকার ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা নিজ নিজ কর্মস্থলে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু থানাগুলো পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ায় জুনিয়র পর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা যোগ দিতে পারেননি।
“তৃণমূল পর্যায়ের পুলিশ কর্মীদের কাজ শুরু করতে অসুবিধা হচ্ছে। এমনকি পুলিশ কর্মকর্তাদের বসার চেয়ারও নেই। পুড়ে গেছে সব যানবাহনও। তবে এসব অসুবিধা সত্ত্বেও, পুলিশ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পুলিশিং কার্যক্রম শুরু করবে,” বলেন ফারুক।
বিভিন্ন পর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা (কনস্টেবল থেকে পুলিশ পরিদর্শক) আইজিপি ময়নুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের দাবি দাওয়া উপস্থাপন করেছেন।
পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আইজিপি ধৈর্য ধরে তাঁদের বক্তব্য শোনেন এবং দ্রুততম সময়ে তা বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের আশ্বাস দেন।
ঢাকা শহরে ট্রাফিক পুলিশ না থাকায় বৃহস্পতিবার তৃতীয়দিনের মতো ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে কাজ করেছেন শিক্ষার্থী ও স্বেচ্ছাসেবকেরা। কোথাও কোথাও আনসার সদস্যরা তাদের সহায়তা করে।