বিশ্লেষকদের মতে, ছাত্রদের কাছে কর্তৃত্ব ছাড় দিচ্ছে সরকার

কামরান রেজা চৌধুরী
2024.10.22
ঢাকা
বিশ্লেষকদের মতে, ছাত্রদের কাছে কর্তৃত্ব ছাড় দিচ্ছে সরকার রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের অপসারণের দাবিতে বঙ্গভবনের সামনে কয়েকটি সংগঠনের ব্যানারে বিক্ষোভের সময় ব্যারিকেড দিয়ে আন্দোলনকারীদের বাধা দেন সেনাসদস্যরা। ২২ অক্টোবরের ২০২৪।
[মেহেদী রানা/ বেনারনিউজ]

ছাত্র আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ছাত্রদের একের পর এক দাবিতে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ছাত্রদের সর্বশেষ দাবি রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ, যার সাথে ইতোমধ্যেই সরকারের উপদেষ্টারা সুর মিলিয়ে কথা বলতে শুরু করেছেন।

এমন পরিস্থিতিতে ছাত্রদের কাছে সরকার নিজের কর্তৃত্ব খাটো করছে কি না সেই প্রশ্ন উঠেছে বিশ্লেষক ও সাধারণ মানুষের মধ্যে।

আন্দোলনকারী ছাত্রদের অনুরোধে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এর পর থেকে ছাত্রদের আন্দোলন, অবরোধ বা ঘেরাও কর্মসূচির পর একে একে সব দাবি পূরণ হয়ে যাচ্ছে।

যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, কেউ অন্যায় করলে তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

প্রসঙ্গত, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নেতাদের দুজন রয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে। এছাড়া আরো কয়েকজন সরকারের বিভিন্ন পদে কাজ করছেন।

ছাত্র আন্দোলনের সর্বশেষ সংযোজন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ। মঙ্গলবার রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবিতে বঙ্গভবনের সামনে বিক্ষোভ করছেন দুই শতাধিক মানুষ। এ সময় পুলিশ ও সেনাসদস্যরা তাঁদের বাধা দেন।

বিক্ষোভকারীদের দাবি, রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন শপথ ভঙ্গ করেছেন। তিনি রাষ্ট্রপতির পদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন।

সম্প্রতি দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে রাষ্ট্রপতি বলেন, পালিয়ে যাওয়ার আগে শেখ হাসিনা যে পদত্যাগ করেছেন, তার কোনো দালিলিক প্রমাণ তাঁর কাছে নেই।

যদিও ছাত্র আন্দোলনের মুখে গত ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে রাষ্ট্রপতি বলেছেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগ পত্র জমা দিয়েছেন এবং আমি তা গ্রহণ করেছি।''

রাষ্ট্রপতির সাম্প্রতিক বক্তব্যের জবাবে সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সোমবার গণমাধ্যমকে বলেন, রাষ্ট্রপতি মিথ্যাচার করেছেন এবং শপথ ভঙ্গ করেছেন। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে মঙ্গলবার বলা হয়, আইন উপদেষ্টার এই বক্তব্যের সঙ্গে সরকার একমত।

তবে সোমবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বঙ্গভবন জানায়, শেখ হাসিনার পদত্যাগ একটি মীমাংসিত বিষয়। এই বিষয় নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি না করতে সকলের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।

আওয়ামী লীগ আমলে নির্বাচিত মো. সাহাবুদ্দিনকে অপসারণের ক্ষমতা একমাত্র জাতীয় সংসদের।

এদিকে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের আগে দ্বাদশ সংসদ বাতিল করে দেন সাহাবুদ্দিন। সংবিধান অনুযায়ী মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও পরবর্তী রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব গ্রহণের আগ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি স্বপদে অধিষ্ঠিত থাকবেন। কোনো কারণে রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে সংসদের স্পিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন।

তবে দ্বাদশ সংসদের স্পিকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী পদত্যাগ করেছেন এবং ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু রয়েছেন কারাগারে।

7ad515ba-988f-4a88-a9c8-b7737d559019.jpeg
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের অপসারণের দাবিতে বঙ্গভবনের সামনে বিক্ষোভ চলাকালে আন্দোলনকারীদের হামলায় আহত একজন পুলিশ সদস্য। ২২ অক্টোবরের ২০২৪। [মেহেদী রানা/বেনারনিউজ]

বিচার বিভাগ তো ঘেরাও দিয়ে সংস্কার করার কথা নয়

বিচার বিভাগসহ বিভিন্ন খাতের সংস্কারে ১০টি কমিশন গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। সেসব কমিশন কাজ শেষ করার আগেই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশাসন, বিচারালয়সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছাত্রদের চাপের মুখে একের পর এক সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

সচিবালয়ে ঢুকে এইচএসসির প্রায় অর্ধেক বিষয়ের পরীক্ষা না দিয়ে পাশের দাবি আদায় করে নিয়েছে শিক্ষার্থীরা। ছাত্রদের বিক্ষোভ, সমাবেশ বা অবরোধের মুখে প্রায় অর্ধশত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন।

গত ১৬ অক্টোবর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীরা হাইকোর্ট ‌ঘেরাও করলে, তাদের দাবির মুখে আওয়ামী লীগের সময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত ১২ বিচারপতিকে বিচারিক কাজ থেকে বিরত রাখা হয়।

এর আগে গত ১০ আগস্ট ছাত্ররা হাইকোর্ট ঘেরাও করে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও আপিল বিভাগের অন্যান্য বিচারপতিদের পদত্যাগে বাধ্য করে।

বিচারপতিদের বিরুদ্ধে গত সপ্তাহে ছাত্রদের ঘেরাও কর্মসূচি “সরকারের অবস্থানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়,” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান।

তিনি বলেন, “সরকার বিচার বিভাগসহ নানা খাত সংস্কারে কমিশন গঠন করেছে, এ ধরনের বিক্ষোভ কর্মসূচি সেই সংস্কার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।”

সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়ার মতে, “বিচার বিভাগ তো ঘেরাও কর্মসূচি দিয়ে সংস্কার করার কথা নয়। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রশ্ন আসতে পারে, সরকার কি তার কর্তৃত্ব ব্যবহার করতে পারছে না?”

“ছাত্ররা যদি বিক্ষোভ সমাবেশের মাধ্যমে সব কিছু করতে যায় তাহলে আগের ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ-যুবলীগের সাথে তো কোনো তফাৎ থাকল না,” বেনারকে বলেন তিনি।

22-BD-student-protests3.jpg
ঢাকায় গণমাধ্যমের সাথে কথা বলছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। ৪ অক্টোবর ২০২৪। [এএফপি]

প্রবণতা বন্ধ না হলে সরকার পরিচালনা কঠিন হয়ে যাবে

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আদালত ঘেরাও কর্মসূচিকে “প্রতিবাদ” হিসাবে দেখছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। রোববার তিনি বেনারকে বলেন, “আমাদের প্রধান লক্ষ্য হলো গণতন্ত্র পূনঃপ্রতিষ্ঠা করা।”

“সরকার কোনোভাবেই সহিংসতা অথবা নৈরাজ্যে বিশ্বাস করে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, “যখনই এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে সাথে সাথে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাম্প্রতিক কর্মসূচির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “প্রতিবাদ করা গণতান্ত্রিক অধিকার। আমরা তো তাদের প্রতিবাদ করতে বাধা দিতে পারি না।”

তবে আদালত প্রাঙ্গণে মিছিল, সমাবেশ, বিক্ষোভ ও ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচি “আইনত নিষিদ্ধ” বলে বেনারকে জানিয়েছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার “ছাত্রদের দ্বারা পরিচালিত। এই সরকারের মূল শক্তি হচ্ছে ছাত্ররা,” তাই এই সরকার “ছাত্রদের প্রভাবের বাইরে গিয়ে তাদের কর্তৃত্ব প্রয়োগ করতে পারবে কি না” সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।

তবে তাঁর মতে, “ছাত্ররা বিভিন্ন দাবি উত্থাপন করতে পারে। কিন্তু সরকারের উচিত সবকিছু মেনে না নিয়ে আইন-নিয়ম-কানুনের মধ্যে থেকে বৃহত্তর জনস্বার্থে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।”

“এই প্রবণতা বন্ধ না হলে মানুষের মধ্যে ধারণা হতে পারে যে সরকার দুর্বল এবং তখন বিভিন্ন গোষ্ঠী বিভিন্ন ধরনের অপকর্ম করবে। এর ফলে সরকার পরিচালনা করা কঠিন হয়ে যাবে,” যোগ করেন তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।