চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবি: সহিংসতায় নিহত ৬
2024.07.16
ঢাকা

কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের বিক্ষোভ চলাকালে মঙ্গলবার ঢাকাসহ তিনি জেলায় কমপক্ষে ছয়জন নিহত ও কয়েকশ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। কোথাও পুলিশ ও ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের ওপর আক্রমণ করেছে, কোথাও আবার দুই পক্ষের সংঘর্ষ হয়েছে।
সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলন সংঘাতপূর্ণ হয়ে ওঠার তিন দিনের মাথায় বিক্ষোভ ও সংঘাতে উত্তাল হয়ে ওঠে দেশ।
এদিন শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এবং তাঁদের প্রতিহত করতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র লীগের নেতা-কর্মীরা প্রকাশ্য হামলা চালান বলে আন্দোলনকারীরা অভিযোগ তুলে এসব ঘটনার বিচার চেয়েছেন।
এসব অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বেনারকে বলেন, “আমাদের কোনো কর্মী কোথাও কারো ওপর হামলা করেনি। উল্টো বিভিন্ন স্থানে আমাদের কর্মীদের ওপর হামলা হয়েছে।”
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, কারা নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে, আমাদের কর্মীদের আহত করছে তা কারও অজানা নয়। এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও প্রতিটি ঘটনার বিচার চাই।
কোটা সংস্কারে নিজেদের দাবি আদায়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বুধবার পবিত্র আশুরার ছুটি থাকায় কোনো কর্মসূচি দেয়া হয়নি।
পরিস্থিতি মোকাবেলায় ও যান চলাচল স্বাভাবিক করতে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঢাকা, চট্টগ্রাম, বগুড়া, রাজশাহী ও রংপুরে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন করার কথা বেনারকে নিশ্চিত করেছেন বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা মোঃ শরিফুল ইসলাম।
এদিকে রাতে ঢাকায় প্রেসক্লাবের সামনে দুটি বাসে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। তবে এই ঘটনায় কাউকে তাৎক্ষণিকভাবে চিহ্নিত করতে পারেনি পুলিশ।
এর আগে মঙ্গলবার শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সড়ক ও রেলপথ দিনভর ছিল বন্ধ। ঢাকার জনজীবন প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে। পথচারীরা সীমাহীন দুর্ভোগ পোহান।

ছয়জন নিহত
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে মঙ্গলবার ঢাকাসহ তিন জেলায় অন্তত ছয়জন নিহত হয়েছেন। এর মাঝে তিনজন চট্টগ্রামে, দুইজন ঢাকায় ও রংপুরে একজন নিহত হবার সংবাদ নিশ্চিত হওয়া গেছে।
চট্টগ্রাম নগরীতে সংঘর্ষের ঘটনায় তিনজন মারা গেছেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ তসলিম উদ্দীন।
তিনি জানান, গুলিবিদ্ধ দুজনকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছে এবং অপর একজন পিটুনিতে নিহত হয়েছেন।
নিহতদের মধ্যে মো ফারুক (৩২) একটি ফার্নিচারের দোকানে চাকরি করতেন, ঘটনার সময় তিনি ওই এলাকা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়া ওয়াসিম আকরাম (২২) চট্টগ্রাম কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র বলেও জানান তিনি।
তাৎক্ষণিকভাবে নিহত অপর একজনের পরিচয় জানাতে পারেননি এই কর্মকর্তা। তিনি জানান, তাঁর হাসপাতালে প্রায় ৪০জন আহত শিক্ষার্থী চিকিৎসা নিচ্ছেন।
আকরামকে চট্টগ্রাম কলেজ শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক বলে দাবি করেছেন চট্টগ্রাম বিএনপির দপ্তর সম্পাদক ইদ্রিস আলী।
চট্টগ্রামে সংঘর্ষের সময় কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরতদের ওপর গুলি ছুড়তে দেখা গেছে এক যুবককে। তবে মাথায় হেলমেট পরা ওই যুবকের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ বাচ্চু মিয়া বেনারকে জানিয়েছেন, রাজধানীর নিউমার্কেট ও সিটি কলেজ এলাকায় সংঘর্ষের পর অজ্ঞাতপরিচয় দুই ব্যক্তির লাশ হাসপাতালে নেওয়া হয়। এ ছাড়া অর্ধশতাধিক আহত ব্যক্তিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তা ইসরারুল হক বেনারকে বলেন, স্থানীয় রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের পর গুলিবিদ্ধ এক শিক্ষার্থীর মরদেহ হাসপাতালে নেওয়া হয়।
তিনি বলেন, সংঘর্ষের পর আহত অন্য ১৬ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর শরিফুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন নিহত আবু সাঈদ (২২) রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন।
রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. মনিরুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা যোগ দিয়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ান।
“অনেক পুলিশ সদস্য এতে আহত হয়েছেন। একজন মারা গেছে, কীভাবে মারা গেছেন তা বলতে পারছি না,” বলেন তিনি।

বিএনপি-জামায়াতের ইন্ধন থাকতে পারে: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
মঙ্গলবার দুপুরে সচিবালয়ে এক ব্রিফিংয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা কোনোভাবে ধ্বংসাত্মক কাজ, ভাঙচুর, রক্তপাত ও দুর্ভোগ সৃষ্টি করলে সরকার আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।
শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াতের ইন্ধন থাকতে পারে বলেও সন্দেহ প্রকাশ করেন তিনি।
তবে মঙ্গলবার সরকারের উদ্দেশে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সাধারণ ছাত্রদের ন্যায়সঙ্গত যৌক্তিক দাবির আন্দোলনকে নস্যাৎ করে দেওয়ার জন্য অস্ত্রশস্ত্র হাতে আপনাদের বাহিনী (ছাত্রলীগ) লেলিয়ে দিয়েছেন। তাঁরা ভয়াবহ অত্যাচার-নির্যাতন করে কোটা সংস্কারের দাবিতে যৌক্তিক আন্দোলন করা শিক্ষার্থীদের দমন করার চেষ্টা করছেন।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে বিনা উস্কানিতে সাধারণ শিক্ষার্থীসহ ছাত্রলীগের ওপর নির্বিচার হামলার ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আন্দোলনকারীদের একটা অংশ রাজাকারের পক্ষে কথা বলছে। এটা স্পষ্ট যে, এর পেছনে রয়েছে বিএনপি-জামায়াত।
আওয়ামী লীগের অফিসে হামলা, পরিবহনে আগুন
বগুড়ায় সরকারি আজিজুল হক কলেজে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার এক পর্যায়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কার্যালয় ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে।
বগুড়া সদর থানার ওসি সাইহান ওয়ালিউল্লা বেনারকে বলেন, আন্দোলনকারীরা হামলা চালিয়ে আওয়ামী লীগের অফিস ভাঙচুর করে। তবে পরে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে।
ঢাকার অদূরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের কর্মীদের মধ্যে সোমবার দিবাগত রাতভর সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে।
রোববার মধ্যরাত থেকে ভোররাত পর্যন্ত এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ছাত্রদের ওপর হামলা চালানো হয়। তবে হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা
বিদ্যালয় ও কলেজগামী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মঙ্গলবার রাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা এম এ খায়ের এ তথ্য নিশ্চিত করে।
এক বিজ্ঞপ্তিতে অধিভুক্ত সব কলেজ বন্ধ ঘোষণার কথা জানায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।

আন্দোলনকারীদের পক্ষে ছাত্রদল, প্রতিহতে ছাত্রলীগ
চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা কোটা সংস্কার সমাধান নয় বরং রাজনৈতিক সুবিধা নিতে চায় দাবি করে ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেছেন, চলমান কোটা আন্দোলনে প্ল্যাটফর্মে এখন যারা রয়েছে তারা রাজাকারের প্রেতাত্মা।
মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজু ভাস্কর্যের সামনে এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি করেন তিনি।
আন্দোলনকারীরা শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্তি করে রাজাকারের রাজনীতি পুনর্বাসন করতে চায় দাবি করে তিনি বলেন, “তাই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে গিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া উচিত।”
এসময় সাদ্দাম দাবি করেন, গত সোমবার আন্দোলনকারীদের হামলায় ছাত্রলীগের কমপক্ষে ৫০০ নেতা-কর্মী আহত হয়েছে।
এদিকে, সোমবার আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার প্রতিবাদ জানিয়ে আন্দোলনকারীদের পক্ষে থাকার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি’র ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল।
মঙ্গলবার সকালে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে এই অবস্থান জানায় ছাত্রদল সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব।
আন্দোলনকারীদের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রীর রোববারের বক্তব্য ও সোমবার শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ছাত্রলীগের বিভিন্ন ইউনিটের কয়েক ডজন নেতা স্বেচ্ছায় তাঁদের পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।
এই ঘটনায় ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম বলেন, বিষয়টি তারা পর্যালোচনা করে দেখছেন।

আদালতের আদেশের অপেক্ষায় সরকার
কোটা সংস্কারের বিষয়ে সরকার সর্বোচ্চ আদালতকে পাশ কাটিয়ে কিছুই করবে না বলে মঙ্গলবার জানিয়েছেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক।
একইদিন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন তার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা পুনর্বহাল করে হাইকোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল আবেদন করেছে রাষ্ট্রপক্ষ।
আগামী ৭ আগস্ট এ আপিল আবেদনের শুনানির তারিখ নির্ধারণ করা আছে বলেও জানান তিনি।
সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল করে ২০১৮ সালে সরকারের জারি করা পরিপত্রকে একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের ৫ জুন হাইকোর্ট অবৈধ ঘোষণা করে।