আন্দোলনে উত্তাল বাংলাদেশ, রোববার থেকে অসহযোগ
2024.08.02
বাংলাদেশে চলমান ছাত্র আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় শুক্রবার এক পুলিশ সদস্যসহ আরো দুই জনের মৃত্যু হয়েছে, আহতের সংখ্যা শতাধিক। এই প্রেক্ষাপটে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা রোববার থেকে সারাদেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছেন।
ছাত্রদের ডাকা গণমিছিল কর্মসূচিতে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ শুক্রবার ঢাকাসহ গোটা দেশ প্রতিবাদমুখর করে তোলে। বেনারের প্রতিনিধিরা ঢাকার বিভিন্নস্থানে এই প্রতিবাদ কর্মসূচি সরেজমিন প্রত্যক্ষ করেছেন।
বেশিরভাগ স্থানে কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে পালন হলেও ঢাকার উত্তরা, এবং ঢাকার বাইরে খুলনা, হবিগঞ্জ, সিলেট, লক্ষ্মীপুরসহ কয়েকটি স্থানে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কর্মীদের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে।
এদিন খুলনায় একজন পুলিশ সদস্য ও হবিগঞ্জে একজন শ্রমিকের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এই আন্দোলন ঘিরে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ২১৬ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে।
প্রতিবাদে উত্তাল দেশ, সরকারের পদত্যাগ দাবি
নয় দফা দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে ছাত্র-শিক্ষক, সংস্কৃতি কর্মী অভিভাবকসহ সকল শ্রেণি পেশার লাখ লাখ মানুষ শুক্রবার সারাদেশে রাস্তায় নেমে এসে সরকারের নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও নিপীড়নের প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
প্রতিবাদ অংশ নিয়ে ছাত্র ও অন্যান্য পেশার মানুষেরা সকল হত্যার দায় নিয়ে সরকারকে পদত্যাগের আহ্বান জানান।
সাপ্তাহিক ছুটির দিন দলেও রাজধানীর ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবক ও সর্বস্তরের হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন।
আন্দোলনকারীরা ছাত্র বিক্ষোভে নিহত ছাত্র ও সাধারণ মানুষের বিচার দাবি করেন এবং এসব হত্যাকাণ্ডের দায় নিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগ দাবি করেন।
বিক্ষোভকারীরা বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ, জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে, শহীদ মিনার, শাহবাগ ও সায়েন্স ল্যাবরেটরির মতো শহরের বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল বের করেন।
রাজধানীর উত্তরায় বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশ গুলি চালায় এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনও এতে যোগ দেয় বলে অভিযোগ উঠেছে।
জুমার নামাজের পর দুপুর শিক্ষার্থী ও অন্যান্য পেশার কয়েক হাজার বিক্ষোভকারী রাস্তায় নামলে উত্তরা এলাকায় সংঘর্ষ শুরু হয়।
সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে ওই এলাকার লোকেরা সাহায্যের আহ্বান জানিয়ে বলেন, আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ তাদের বাড়িতেও হামলা করেছে। কারণ তারা আন্দোলনকারীদের আশ্রয় দিয়েছিলেন।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বিএম ফরমান আলী বেনারকে বলেন, তারাও বিষয়টি শুনেছেন তবে সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত নয়।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের “দফা এক, দাবি এক, শেখ হাসিনার পদত্যাগ” বলে স্লোগান দিতে শোনা যায়।
ঢাকার সায়েন্স ল্যাবরেটরি ক্রসিংয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজের এইচএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্র সাফওয়ান ওয়াসিক অভিযোগ করেন, গণহারে গ্রেপ্তারের কারণে শিক্ষার্থীরা বাড়িতে থাকতে পারছে না।
“শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ হত্যার পাশাপাশি গণহারে গ্রেপ্তার ও ভয়ভীতি দেখানোর জন্য শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে,” বলেন তিনি।
জাতীয় প্রেসক্লাব এলাকা থেকে শুরু হয়ে ‘দ্রোহযাত্রা’ নামে নাগরিক সমাজের ডাকে আয়োজিত একটি শোভাযাত্রা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার গিয়ে শেষ হয়। সেখান থেকে চার দফা দাবিতে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করে ছাত্র-শিক্ষক ও সর্বস্তরের জনগণ।
দাবি আদায় না হলে রোববার বিকেল ৩টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভ মিছিল করা হবে বলে ঘোষণা দেন ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি রাগীব নাঈম।
দাবিগুলো হলো; গ্রেপ্তারকৃত ছাত্র-ছাত্রীদের মুক্তি, কারফিউ প্রত্যাহার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া এবং সরকারের পদত্যাগ।
শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, মানবাধিকার কর্মী, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষসহ হাজার হাজার মানুষ বৃষ্টির উপেক্ষা করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে বিক্ষোভে যোগ দেন।
খুলনায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের মধ্যে সুমন কুমার ঘরামী (৩৩) নামে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ লাইন্সে কর্মরত সদস্য নিহত হয়েছেন।
খুলনা মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. মোজাম্মেল হক সাংবাদিকদের এ তথ্য নিশ্চিত করেন। সংঘর্ষে ২০ থেকে ২৫ জন গুরুতর আহত হয়েছেন বলে জানান তিনি।
হবিগঞ্জে পুলিশ-বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে একজন নিহত হয়েছেন। আজ শুক্রবার বিকেলে হবিগঞ্জ শহরে এ ঘটনা ঘটে। নিহত ব্যক্তির নাম মোস্তাক মিয়া (২৪)। তিনি পেশায় শ্রমিক।
সিলেটে ‘গণমিছিলে’ পুলিশের সাউন্ড গ্রেনেড ও শটগানের গুলি, সংঘর্ষে আহত অন্তত ২০।
ইন্টারনেট সীমিত করার অভিযোগ
একটি এক্স (সাবেক টুইটার) পোস্টে, ইন্টারনেটের অবজারভেটরি সংস্থা নেটব্লকস বলেছে, মেট্রিক্স দেখায় যে সামাজিক মিডিয়া এবং মেসেজিং প্ল্যাটফর্ম ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ এবং টেলিগ্রাম এবং মোবাইল ডেটাও বাংলাদেশে সীমাবদ্ধ সীমিত করা হয়েছে।
আন্দোলন চলাকালে ইন্টারনেট সীমিত করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন বিক্ষোভকারীরা।
সরকার অবশ্য ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
তবে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক শুক্রবার নাটোরে নিজ বাসভবনে জাতীয় শোক দিবসের আলোচনা সভায় বলেন, ‘তরুণ প্রজন্মের কাছে যদি আমার কোনো ভুল হয়ে থাকে, আমি প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। ইন্টারনেট ব্যাহত হওয়া এবং সামাজিক মাধ্যমে গুজব প্রতিরোধে ব্যর্থ হওয়ার দায় আমি নিজের কাঁধে তুলে নিচ্ছি।”
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে কোনো ভুল করে থাকলে, তার জন্য করজোড়ে তরুণ প্রজন্মের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন পলক।
নতুন কর্মসূচি অসহযোগ
শুক্রবার বিক্ষোভ শেষে এদিন সন্ধ্যায় নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
এক বিবৃতিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সহ-সমন্বয়ক মু. মেহেদী হাসান বলেন, “ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে হামলা ও তাদের উপর গুলি করার প্রতিবাদে রক্তখেকো স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে আগামী ৪ আগস্ট রোববার থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়া হলো।
অসহযোগ আন্দোলন বাস্তবায়নের জন্য দেশবাসীর কাছে আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, সফল করার জন্য আপনারা কোনো ধরনের ট্যাক্স কিংবা খাজনা প্রদান করবেন না; বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল, পানিসহ অন্যান্য সকল সরকারি ইউটিলিটি বিল প্রদানে বিরত থাকুন; সরকারি-বেসরকারি সকল ধরনের প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত বন্ধ রাখুন; সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখুন; রেমিটেন্স পাঠানো থেকে বিরত থাকুন; এবং সরকারি সকল ধরনের আয়োজন বর্জন করুন।
এতে বলা হয়, “আপনারা ভবনে-ভবনে, পাড়ায়-পাড়ায়, মহল্লায়-মহল্লায়, জেলায় জেলায় আন্দোলন গড়ে তুলুন। প্রত্যেক দল-মতের মানুষকে আহ্বান জানাচ্ছি আন্দোলন সফল করার জন্য। এছাড়াও ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আগামীকালের বিক্ষোভ মিছিল সফল করুন।”
সহিংসতায় অন্তত ৩২ শিশুর মৃত্যু: ইউনিসেফ
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনে সহিংসতায় অন্তত ৩২ শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা—ইউনিসেফ।
এ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে সবসময় শিশুদের সুরক্ষিত রাখার ওপর গুরুত্ব দিয়ে সংস্থাটি এক বিবৃতিতে বলেছে, শিশুদের এই মৃত্যু ভয়ানক ক্ষতি, তাদের সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব সবার।
শুক্রবার ইউনিসেফের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে ইউনিসেফের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক সঞ্জয় উইজেসেকেরা বলেন, “জুলাই মাসে বিক্ষোভের সময় অন্তত ৩২ শিশু নিহত হয়েছে বলে নিশ্চিত হয়েছে ইউনিসেফ। এ ছাড়া অনেক শিশু আহত হয়েছে এবং অনেককে আটক করা হয়েছে। শিশুদের এই মৃত্যু ভয়ানক ক্ষতি। সব ধরনের সহিংসতার নিন্দা জানায় ইউনিসেফ।”
৭৮ এইচএসসি পরীক্ষার্থী জামিনে মুক্ত
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গ্রেপ্তার হওয়া এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের মুক্তি না দিলে তাদের সহপাঠীরা পরীক্ষায় বসবে না -বৃহস্পতিবার এমন হুশিয়ারির খবর প্রকাশ হলে শুক্রবার ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় ৭৮ জন পরীক্ষার্থীকে জামিনে মুক্তি দিয়েছে আদালত।
শুক্রবার আইন মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বিশেষ উদ্যোগে শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও দেশের বিভিন্ন আদালত থেকে ৭৮ জন এইচএসসি পরীক্ষার্থী জামিন পেয়েছেন।
“কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে চলমান সহিংসতা ও নাশকতামূলক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রুজু হওয়া মামলায় গ্রেপ্তারকৃত এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষার কথা বিবেচনায় করে আইনমন্ত্রী তাদের জামিনের বিশেষ উদ্যোগ নেন,” বলা হয় বিজ্ঞপ্তিতে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনে সহিংসতার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে যাতে কারাগারে যেতে না হয় সে বিষয়ে সরকার ব্যবস্থা নিয়েছে।