কক্সবাজারে গণধর্ষণ: পুলিশ–র‌্যাবের পরস্পরবিরোধী মন্তব্যকে দুঃখজনক বললেন বিচারক

কামরান রেজা চৌধুরী
2022.01.04
ঢাকা
Share on WhatsApp
Share on WhatsApp
কক্সবাজারে গণধর্ষণ: পুলিশ–র‌্যাবের পরস্পরবিরোধী মন্তব্যকে দুঃখজনক বললেন বিচারক কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে পর্যটকদের ভিড়। ১৫ ডিসেম্বর ২০২১।
[সুনীল বড়ুয়া/বেনারনিউজ]

দুই সপ্তাহ আগে কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়ে গণধর্ষণের শিকার এক নারী সম্পর্কে তদন্ত চলাকালে গণমাধ্যমে পুলিশ ও র‌্যাবের পরস্পরবিরোধী মন্তব্যকে দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ।

মঙ্গলবার ওই ধর্ষণ ঘটনা সম্পর্কে দুই বাহিনীর দুই ধরনের মন্তব্য সম্পর্কে দায়ের করা এক রিট আবেদন শুনানিকালে এই মন্তব্য করে বিচারপতি এনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ। তবে আদালত রিটটি নিষ্পত্তি করেনি।

‘‘সরকারি দুই বাহিনীর দুই ধরনের মন্তব্যের কারণে জনগণের মাঝে ভুল বার্তা যায় বলে আদালত জানিয়েছেন,’’ বেনারকে বলেন রিটকারী আইনজীবী এম. আব্দুল্লাহ আল হারুন রাসেল।

কক্সবাজারে ওই নারী ধর্ষণের ব্যাপারে সরকারি দুই বাহিনীর মন্তব্যের পর বিষয়টি আদালতের নজরে আনতে রিট দায়ের করেন সুপ্রিমকোর্টের ওই আইনজীবী।

উচ্চ আদালতের এই মন্তব্য জনগণ ও সরকারি প্রতিষ্ঠানকে কিছুটা হলেও ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ প্রসঙ্গে আইনজীবী রাসেল বেনারকে বলেন, ধর্ষণ ঘটনার পর “তদন্ত চলাকালেই টুরিস্ট পুলিশ বলল, ধর্ষণের শিকার ওই নারী তিন মাস আগে কক্সবাজার আসেন এবং ধর্ষণকারী তাঁর পূর্ব পরিচিত। আবার র‌্যাব বলল, না ওই নারী তিন দিন আগে কক্সবাজার আসেন। এই দুই ধরনের কথা বলে মূলত তাঁরা ধর্ষণের শিকার ওই নারীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।”

তাঁর মতে, “তাঁদের উচিত ছিল তদন্তের কাজটি শেষ করা এবং ওই নারী সম্পর্কে এ ধরনের মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকা।’’

“আজকে আদালত রিটটি শুনানিকালে বলেছেন, তদন্ত চলাকালে ধর্ষণের শিকার ওই নারী সম্পর্কে সরকারি দুই সংস্থার দুই ধরনের মন্তব্য সত্যিই দুঃখজনক,” বলেন রাসেল।

তিনি বলেন, “আদালত জানিয়েছেন, তদন্ত চলাকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মিডিয়ায় বিভিন্ন বক্তব্য প্রদান করেন, যেটি উচ্চ আদালতের একটি রায় অনুযায়ী করতে পারেন না। এগুলো বন্ধ করতে হবে।”

তবে আদালত এ ব্যাপারে কোনো আদেশ জারি করেনি বলে জানানা তিনি।

গত ২২ ডিসেম্বর কক্সবাজার শহরের কবিতা চত্বর রোডসংলগ্ন একটি ঘরে আটকে রেখে এক নারীকে ধর্ষণ করা হয়।

ধর্ষণকারীরা সেখান থেকে ওই নারীকে জিয়া গেস্ট ইন নামের আবাসিক হোটেলে নিয়ে যায়। সেখানে দ্বিতীয় দফায় তাঁকে ধর্ষণ করা হয়।

পরের দিন ২৩ ডিসেম্বর ধর্ষণকারী চার জনের নাম উল্লেখ করে এবং দুই-তিন জনকে অজ্ঞাত আসামি করে মামলা করেন ভুক্তভোগীর স্বামী।

ধর্ষণের মূল হোতা স্থানীয় আশিকুল ইসলামসহ মোট সাত আসামিকে আটক করেছে পুলিশ। আশিককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সোমবার তিন দিনের পুলিশি রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত।

তবে মামলার তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই মিডিয়ায় দুই ধরনের বক্তব্য দেন পুলিশ ও র‌্যাব কর্তারা।

বিচার বিভাগের মন্তব্যের ‘ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে

সম্প্রতি কক্সবাজারে ধর্ষণের শিকার নারী ও মামলার বাদী সম্পর্কে সরকারি দুই বাহিনীর দুই রকম মন্তব্যের ব্যাপারে হাইকোর্টের মন্তব্যকে “ইতিবাচক” হিসেবে আখ্যায়িত করেন হাইকোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।

তিনি বেনারকে বলেন, “একটি গণতান্ত্রিক সমাজে বিচার বিভাগ যদি কোনো মন্তব্য করে সেটির ব্যাপারে নির্বাহী বিভাগের উচিত বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। এর ফলে কোনো ভুল হয়ে থাকলে সেটি সাথে সাথে সংশোধন করা যায়।”

বাংলাদেশে অনেক সময় বিষয়গুলোকে সরকারের নজরে না আনা গেলেও বিচার বিভাগের মন্তব্যগুলোর কিছু “ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে,” বলে মনে করেন ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময়।

তিনি বলেন, মিডিয়ার মাধ্যমে এই মন্তব্যগুলো সংশ্লিষ্ট বিভাগের নজরে এলে “সরকারি বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাসহ অন্যান্যরা এ ব্যাপারে সচেতন থাকেন।”

“বিচার বিভাগের মন্তব্যের কারণে জনগণের মধ্যে প্রভাব পড়ে এবং সেটি প্রকারান্তরে সরকারের ওপর এক প্রকারের চাপ সৃষ্টি করে,” বলেন তিনি।

মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, তদন্ত চলাকালে কোনো মামলার ব্যাপারে মিডিয়াতে কিছু না বলার জন্যে উচ্চ আদালত থেকে পুলিশের প্রতি একটি নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু সেটি মানা হচ্ছে না।

“কক্সবাজারে ধর্ষণের মামলার ব্যাপারে পুলিশ-র‌্যাবের উচিত ছিল বিষয়টি নিয়ে মিডিয়ায় কোন মন্তব্য না করা। এই মন্তব্যের মাধ্যমে ধর্ষণের শিকার ওই নারীকে অসম্মান করা হয়েছে এবং তাঁর বিচার পাওয়ার পথ অবরুদ্ধ করে দেয়ার চেষ্টা হয়েছে,” বলেন নূর খান।

ওই ধর্ষণ ঘটনা সম্পর্কে টুরিস্ট পুলিশ এবং র‌্যাবের দুই ধরনের বক্তব্যের কারণ “দুই বাহিনীর মধ্যে প্রতিযোগিতা। কোন সংস্থা কত ভালো তদন্ত করতে পারে,” তা দেখানোর চেষ্টা বলে মনে করেন তিনি।

“কিন্তু তাঁরা দেখছেন না যে এর মাধ্যমে একজন অসহায় নারীকে তাঁরা সমাজের চোখে চরম অসম্মান করছেন। এটি সত্যিই দুঃখজনক। এগুলো বন্ধ করতে হবে,” বলেন নূর খান।

তাঁর মতে, “সরকারের উচিত, এই ধরনের কার্যক্রম যাঁরা করেন তাঁদের চিহ্নিত করে শাস্তির ব্যবস্থা করা। তা করা গেলে অন্যরা এ ব্যাপারে সচেতন হবেন।’’

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।