ফরিদপুরে মন্দিরে আগুনের পর দুই ভাইকে হত্যা: সনাতন ধর্মের ১২ জন কারাগারে

আহম্মদ ফয়েজ
2024.04.24
ঢাকা
ফরিদপুরে মন্দিরে আগুনের পর দুই ভাইকে হত্যা: সনাতন ধর্মের ১২ জন কারাগারে ফরিদপুরের মধুখালীতে দুই ভাইকে পিটিয়ে হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ জনতা গাছের গুঁড়ি ফেলে ফরিদপুর–খুলনা মহাসড়ক অবরোধ করলে পুলিশ তা সরিয়ে নিচ্ছে। ২৪ এপ্রিল ২০২৪।
[বেনারনিউজ]

ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলায় একটি মন্দিরে আগুন দেওয়ার অভিযোগ তুলে সন্দেহজনকভাবে দুই জনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় এ পর্যন্ত সনাতন ধর্মের ১২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বুধবার সকাল থেকে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) চার প্লাটুন সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।

ফরিদপুরের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম বেনারকে বলেন, “সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এলাকায় অতিরিক্ত বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। সব পক্ষ যেন শান্ত থাকে, সে বিষয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর রয়েছে।”

বিজিবি সদর দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, ফরিদপুর জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেটদের সঙ্গে ফরিদপুর সদরসহ মধুখালী উপজেলার বালিয়াকান্দি পঞ্চপল্লীর কাছে এবং বাঘাটে বাজার এলাকায় যৌথ বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয়ে টহল পরিচালনা করা হচ্ছে।

“বর্তমানে এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেটসহ যৌথ বাহিনীর সঙ্গে বিজিবির টহলের পাশাপাশি গ্রাম পুলিশ অবস্থান করছে,” বলেন তিনি।

মধুখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিরাজ হোসেন বেনারকে বলেন, “বুধবার পর্যন্ত পুলিশ ১২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এরা সবাই সনাতন ধর্মাবলম্বী।”

ফরিদপুর জেলা আদালতের পুলিশ পরিদর্শক (কোর্ট ইনচার্জ) মো. আবুল খায়ের মিয়া বেনারকে বলেন, গ্রেপ্তার ১২ জনকে হাজির করা হলে আদালত তাঁদের সবাইকে জেল হাজতে পাঠায়।

তিনি বলেন, “পুলিশের পক্ষ থেকে রিমান্ড চাওয়া হয়নি এবং আসামিদের পক্ষ থেকেও জামিন চাওয়া হয়নি। তাই আদালত আসামিদের জেল হাজতে পাঠিয়ে দিয়েছেন।”

যেভাবে ঘটনার সূত্রপাত

গত বৃহস্পতিবার রাতে ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার ডুমাইন ইউনিয়ন পরিষদের পঞ্চপল্লী এলাকায় একটি মন্দিরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী স্থানীয় একটি স্কুলে অবস্থান করা নির্মাণ শ্রমিকদের ওপর হামলায় চালায় এবং দুই শ্রমিককে হত্যা করে।

নিহত দুই শ্রমিক হলেন মো. আশরাফুল (২০) ও তাঁর ভাই মো. এরশাদুল (২১)।

তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে শুক্রবার ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক কামরুল হাসান তালুকদার বেনারকে জানিয়েছিলেন, “নিহতদের মধ্যে একজন ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পরপরই এবং অন্যজন শুক্রবার ভোরে মারা যান। তারা আপন ভাই।”

পরবর্তীতে জানা যায়, নিহত দুই নির্মাণ শ্রমিক পার্শ্ববর্তী নওপাড়া ইউনিয়নের বাসিন্দা। অন্য শ্রমিকদের সঙ্গে তাঁরাও স্কুলটিতে অবস্থান করছিলেন।

ঘটনার দিন স্থানীয় ডুমাইন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান তপন বেনারকে বলেছিলেন, “হিন্দু অধ্যুষিত ওই গ্রামে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে মন্দিরে আগুন লাগে। মন্দিরের পাশে পঞ্চপল্লী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শৌচাগার নির্মাণের জন্য শ্রমিকরা সেখানে অবস্থান করছিলেন। স্থানীয় বাসিন্দারা ধারণা করেন, তারাই ওই ঘটনা ঘটিয়েছেন এবং সেই ধারণার ভিত্তিতেই হামলা চালায়।”

তিনি আরও বলেন, “নির্মাণ শ্রমিকদের বিদ্যালয়টির একটি কক্ষে আটকে রেখে হামলা চালানো হয় এবং গ্রামবাসী পুলিশকেও অবরুদ্ধ করে রাখে। পরবর্তীতে পাশের জেলা থেকে অতিরিক্ত পুলিশ এনে ফাঁকা গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে শ্রমিকদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়।”

আহত শ্রমিক ও স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, ওই ঘটনায় চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান ও ইউপি সদস্য অজিত কুমার সরকার নেতৃত্ব দিয়েছেন।

ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে পুলিশও এমন প্রমাণ পেয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম।

“একটি ভিডিও ফুটেজে ডুমাইন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহ আসাদুজ্জামান তপন ও ইউপি সদস্য অজিত কুমার সরকারকে দেখা গেছে। তাঁরা এখন পলাতক, আমরা তাঁদের খুঁজছি,” বলেন মোর্শেদ।

নওপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান মো. জাহিদুল হাসান বেনারকে বলেন, “আমার এলাকার দুটি ছেলে মারা গেছে। এলাকার মানুষ ক্ষেপে আছে।”

তিনি বলেন, বাইরে যাতে কোনো প্রকার জনসমাগম না ঘটে, সেদিকে কঠোর নজর রেখেছে যৌথ বাহিনী।

এদিকে হত্যার বিচার দাবিতে মঙ্গলবার স্থানীয় কয়েক হাজার মুসলমান “সর্বস্তরের জনগণ” ব্যানারে বিক্ষোভ করে ও দিনভর ফরিদপুর-খুলনা মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে।

বিক্ষোভকারীদের সড়ক থেকে সরাতে গেলে পুলিশের সঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দাদের সংঘর্ষ হয়। এতে পুলিশের ছোড়া রাবার বুলেট ও কাঁদানো গ্যাসে কমপক্ষে ১৫ জন আহত হন।

রাতেই সংবাদ সম্মেলন করে পুলিশ সুপার মোর্শেদ জানান, এই ঘটনায় ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং অভিযুক্ত চেয়ারম্যান ও মেম্বারকে খোঁজা হচ্ছে।

বুধবার মধুখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিরাজ হোসেন বেনারকে বলেন, “বৃহস্পতিবার মন্দিরে অগ্নিকাণ্ড, দুই শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যা ও মঙ্গলবার পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় পৃথক তিনটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।”

তবে এসব মামলায় কাদের আসামি করা হয়েছে, সে বিষয়ে কিছু বলতে চাননি মিরাজ।

ফরিদপুরে মন্দিরে হামলা ও পিটিয়ে দুই শ্রমিককে হত্যার ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি।

এই কমিটি এলাকা পরিদর্শন করে প্রতিবেদন প্রকাশ করবে বলে জানিয়েছেন দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।

অন্যদিকে, মন্দিরে অগ্নিকাণ্ডের পর সন্দেহের বশে দুই মুসলিম শ্রমিককে হত্যার ঘটনা এবং এর প্রতিবাদে ফরিদপুরের ‘তৌহিদি জনতার’ মিছিলে পুলিশি হামলায় মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ।

সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নতুন নয়

নব্বই ভাগ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নতুন নয়।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে সংখ্যালঘুদের ওপর (বেশির ভাগ হিন্দু) ১২টি হামলার ঘটনায় কমপক্ষে ২৮ জন আহত হয়েছেন।

আসকের হিসাব মতে, গত বছর সংখ্যালঘুদের ওপর ২২টি হামলার ঘটনায় একজন নিহত, ৮১ জন আহত, ১০৮টি বাড়ি ও ২৯টি দোকানপাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

বাংলাদেশে ২০২১ সালের অক্টোবরে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় কয়েকটি জেলায় কমপক্ষে ছয়জন সনাতন ধর্মাবলম্বী নিহত হন এবং দেড় শতাধিক মন্দিরে ভাঙচুর চালায় দুর্বৃত্তরা।

এই ঘটনায় ভারতও কড়া প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।