প্রথম দিনেই বাধার মুখে সড়ক পরিবহন আইন
2019.11.18
ঢাকা
বাস্তবায়নের প্রথম দিনেই তীব্র বাধার মুখে পড়েছে গতবছর নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পর সংসদে পাশ হওয়া সড়ক পরিবহন আইনের বাস্তবায়ন।
‘অতিরিক্ত’ জেল-জরিমানার বিধান বাতিল করে আইনটি সংশোধনের দাবিতে সোমবার সারাদেশে রাস্তায় বিক্ষোভ ও কমপক্ষে ১০ জেলায় যানবাহন পরিচালনা বন্ধ রেখেছেন পরিবহন শ্রমিকরা।
ঢাকায় রাস্তার পাশে অপেক্ষমাণ দুই শিক্ষার্থীকে চাপা দিয়ে হত্যা ঘটনার জেরে সারাদেশে ব্যাপক গণবিক্ষোভের পর সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ পাশ করে সরকার।
সেই আইন বাস্তবায়নের প্রথম দিনেও নওগাঁ জেলা সদরে বাসের জন্য অপেক্ষমাণ এক মা এবং তাঁর মেয়েকে চাপা দিয়েছে নিয়ন্ত্রণহীন এক ট্রাক।
তবে পরিবহন শ্রমিকদের বাধার কারণে আইনে কঠিন শাস্তির বিধান থাকলেও আইন ভঙ্গের দায়ে ‘খুব’ বেশি সাজা দিচ্ছে না বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ভ্রাম্যমাণ আদালত।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি শাজাহান খান বেনারকে বলেন, “সড়ক পরিবহন আইনের কিছু ধারা পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের স্বার্থ বিরোধী বলে আমরা মনে করি। আইনটির সংশোধন প্রয়োজন।”
তিনি বলেন, “আমরাও চাই সড়কে দুর্ঘটনা বন্ধ হোক। কিন্তু কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে কোনো তদন্ত ছাড়াই চালককে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।”
শাজাহান খান বলেন, “আর সড়ক পরিবহন আইনটিতে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর জন্য পাঁচ বছরের জেল ও জরিমানার বিধান করা হয়েছে। কেউ কি ইচ্ছা করে দুর্ঘটনা ঘটায়? দুর্ঘটনার জন্য জেল কেন? এটির সংশোধন প্রয়োজন।”
শাজাহান খান বলেন, “পরিবহন মালিক-শ্রমিক সবাই চায় আইনটির সংশোধন। আর এই আইন পুরোপুরি কার্যকর হলে অপব্যবহারের আশঙ্কা রয়ে যায়।”
তিনি বলেন, একারণে চট্টগ্রাম, বগুড়া, পুরো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাসহ সারাদেশে পরিবহন শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেছে। আমাদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ চলবে।”
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, কোনো মহলের চাপে সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর করা থেকে বিরত থাকবে না সরকার।
সোমবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “১ নভেম্বর থেকে সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর হলেও আজ সোমবার থেকে তা বাস্তবায়ন হচ্ছে। এ আইন কাউকে শাস্তি দিতে নয়, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে এবং দুর্ঘটনা কমাতে ব্যবহার করা হবে।”
এই আইন যেন সহনীয় পর্যায়ে কার্যকর করা হয়, তার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”
এ আইন বাস্তবায়নে বিভিন্ন মহল আরও সময় চাচ্ছিল, তাদেরকে সময় দেওয়া হলো না কেন সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, “এ আইন আরও দেরিতে বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন মহল থেকে চাপ এসেছিল। সেই চাপ বিবেচনা করেই এই ১৫-১৬ দিন বাড়তি সময় দেওয়া হয়েছে।”
তিনি বলেন, “এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তিনি বলেছেন, সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়নে আর সময় দেওয়া যাবে না।”
হঠাৎ দক্ষিলাঞ্চলে পবিবহন ধর্মঘট
কোনও ধরনের ঘোষণা ছাড়াই নতুন সড়ক আইনের কিছু বিধান সংশোধনের দাবিতে সোমবার থেকে খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট পালন করছেন বাসচালক ও শ্রমিকরা।
সকাল থেকে ধর্মঘটের কারণে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন যাত্রীরা।
খুলনা জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি কাজী মো. নুরুল ইসলাম বেবী সাংবাদিকদের বলেন, “সড়ক পরিবহন আইনের সংশোধনের দাবিতে রোববার থেকেই ধর্মঘট শুরু করেছেন বাস শ্রমিকরা। সেটা ছিল আংশিক। আজ থেকে ১০ জেলার সব বাসচালকও ধর্মঘট শুরু করেছেন।”
তিনি বলেন, “রোববার সকালে ঝিনাইদহে মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন ফেডারেশনের বৈঠকে এই অঞ্চলের সকল মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন নেতারা উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠক শুরুর আগে থেকেই চালকরা কর্মবিরতি শুরু করেছিলেন।”
বেবী বলেন, ফেডারেশনের শ্রমিক ও নেতারা মনে করেন সড়ক পরিবহন আইনের ধারাগুলো খুব কঠোর। জেল-জরিমানা বেশি। এগুলো সংশোধন করতে হবে।
‘সামান্য জরিমানা’
বিআরটিএ’র এনফোর্সমেন্ট পরিচালক ও একটি ভ্রাম্যমাণ আদালতের প্রধান একেএম মাসুদুর রহমান বেনারকে বলেন, “আমরা আজকে প্রথমবারের মতো সড়ক পরিবহন আইনটি বাস্তবায়ন করেছি। এজন্য রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে আটটি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেছি।”
ঢাকায় মোট আটটি ভ্রাম্যমাণ আদালত সোমবার মোট ৮৮টি মামলা দায়ের করেছে জানিয়ে তিনি বেনারকে বলেন, “জরিমানা করা হয়েছে এক লাখ ২১ হাজার নয়’শ টাকা।”
মাসুদুর রহমান বলেন, আমরা মালিক-শ্রমিকদের বিরুদ্ধে নই। আপাতত আমরা কাউকে কঠোর জরিমানা করব না। আমাদের উদ্দেশ্য জেল-জরিমানা করা নয়। আইনটির উদ্দেশ্য সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা।”
তিনি বলেন, “আইনে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান থাকলেও আমরা এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকার বেশি জরিমানা করিনি।”
পরিচালক মাসুদুর রহমান বলেন, “পরিবহন শ্রমিকরা রাস্তায় বিক্ষোভ করছে বলে আমরা জেনেছি। বর্তমান অবস্থায় আমরা কাউকেই হার্শ পানিশমেন্ট দেবো না। তাই, আমরা আজকে খুব সামান্য অঙ্কের জরিমানা করেছি। আমরা ধীরে চলার পক্ষে।”
নওগাঁয় মা-মেয়ের মৃত্যু
সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়নের প্রথম দিনেই বেপরোয়া ট্রাকের চাপায় মা ও মেয়ের মৃত্যু হয়েছে।
সোমবার সকাল পৌনে নয়টায় রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কে ডাক্তারের মোড় এলাকায় আদরী বেগম (২৫), তার স্বামী শহীদ হোসেন ও মেয়ে শম্পা (৬) বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
এমন সময় একটি মাইক্রোবাসকে ওভারটেক করতে গিয়ে অপেক্ষমাণ যাত্রীদের চাপা দেন ট্রাকচালক।
নওগাঁ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সোহরাওয়ার্দী হোসেন বেনারকে বলেন, “আমরা আদরী ও তাঁর মেয়েকে চাপা দেয়া ট্রাকটিকে শনাক্ত করেছি। ট্রাকটির হেলপার চালকের আসনে ছিল। অচিরেই তাকে গ্রেপ্তার করা হবে।”
তিনি বলেন, “ট্রাক চাপায় ঘটনাস্থলেই মা-মেয়ের মৃত্যু হয়। আমরা এই মৃত্যুর দায়ে মামলা করেছি।”
নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন ঢাকা সিটি কলেজের ছাত্র মহিউদ্দীন ফকির।
তিনি বেনারকে বলেন, “রমিজ উদ্দীন কলেজের দুই শিক্ষার্থী বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তাদের এসে চাপা দিয়ে হত্যা করল বাস চালক। আজকেও নওগাঁয় বাসের জন্য অপেক্ষমাণ এক মা ও তার শিশু কন্যাকে চাপা দিয়েছে একটি ট্রাক।”
মহিউদ্দীন বলেন, “অর্থাৎ তারা হত্যা করবে। আর তাদের কিছু বলা যাবে না। সরকার কিছু করলেই ধর্মঘট। এটি কেমন কথা। সরকারের উচিত কঠোরভাবে এই আইন বাস্তবায়ন করা।”