জাহাজ ঢুকতে না দেওয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে প্রতিবাদ রাশিয়ার

আহম্মদ ফয়েজ
2023.02.22
ঢাকা
জাহাজ ঢুকতে না দেওয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে প্রতিবাদ রাশিয়ার পাবনার রূপপুরে নির্মাণাধীন পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সামনে দিয়ে মোটরসাইকেল চালিয়ে যাচ্ছেন দুইজন আরোহী। ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩।
[রয়টার্স]

যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় থাকা রুশ জাহাজ প্রবেশ করতে না দেওয়ায় মঙ্গলবার মস্কোতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কামরুল আহসানকে তলব করে রাশিয়া।

তবে এ বিষয়ে ঢাকা এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া দেয়নি। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বুধবার সাংবাদিকদের জানান, রাষ্ট্রদূত তলবের বিষয়টি বাংলাদেশ সরকার বিশ্লেষণ করবে। এরপরেই এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানো হবে।

রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা তাসের এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনের সত্যতা নিশ্চিত করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “আমরা এ বিষয়ে আমাদের রাষ্ট্রদূতকে একটি প্রতিবেদন পাঠাতে বলেছি। সেখানে কী আলোচনা হয়েছে আমরা সেটা বিশ্লেষণ করব।”

শুধু জাহাজ প্রবেশ করতে না দেওয়া নিয়ে নয়, সেখানে দ্বিপক্ষীয় আরও বেশ কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানান শাহরিয়ার আলম।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, রাষ্ট্রদূতের প্রতিবেদন পাওয়ার পর বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে সাংবাদিকদের বিস্তারিত জানানো হবে।

এর আগে মঙ্গলবার, রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি উদ্ধৃত করে তাস জানিয়েছিল, আলোচনায় দুই দেশের সহযোগিতামূলক সম্পর্কের বর্তমান অবস্থা নিয়ে রাশিয়া সরকারের “গুরুতর উদ্বেগ” স্থান পায়।

রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঐ বিবৃতিতে বলে, “রাশিয়ান জাহাজকে বাংলাদেশের বন্দরে ঢোকা নিষিদ্ধ করার বিষয়ে তার দেশের কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের বিষয়ে আমরা কূটনৈতিক মিশনের প্রধানের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি।”

এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় থাকা রাশিয়ার ৬৯টি জাহাজকে বাংলাদেশের বন্দরে ঢুকতে দেবে না বলেও রাশিয়াকে জানায় ঢাকা।

“মার্কিন নিষেধাজ্ঞার হুমকিতে বাংলাদেশ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে,” বলে তাসের কাছে মন্তব্য করেন রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা।

মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা রাশিয়ার জাহাজ উরসা মেজরকে বাংলাদেশের বন্দরে ঢুকতে না দেওয়ার নজিরবিহীন ঘটনার পর গত বছরের ডিসেম্বরে উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার ভিত্তিতে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ৬৯টি রাশিয়ার জাহাজকে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে প্রবেশ ঠেকাতে সতর্ক থাকার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে সতর্ক করে সরকার।

রাশিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে তলব করার ঘটনাটি এমন এক সময়ে ঘটল যখন গত কয়েক সপ্তাহে কয়েকজন মার্কিন কূটনীতিক বাংলাদেশ সফর করেছেন।

গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের কাউন্সেলর ডেরেক শোলে বাংলাদেশ সফর করেন। তাঁর সফরকালে সিলেটে এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে কাজ করতে চায়।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে গত সাত মাসে মার্কিন সরকারের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা বাংলাদেশ সফর করেছেন।”

দুই দেশই ভুল বোঝাবুঝি দূর করে সম্পর্কের উন্নতি করতে চায় বলে মন্তব্য করেন তিনি।

‘কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ’

রাশিয়ায় বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূতকে তলব করা প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বেনারকে বলেন, “এ ঘটনা বাংলাদেশের জন্য কিছু কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এখন আমাদের কূটনীতিকদের উচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া উভয়ের সাথে সুসম্পর্ক রেখে সমস্যার সমাধান করা।”

“ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জন্য এ ধরনের কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ আরও বাড়বে,” বলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাশিয়াকে তাঁর সবচেয়ে শক্তিশালী মিত্র হিসেবে গণ্য করেন। আওয়ামী লীগ এবং রাশিয়ার মধ্যে সুসম্পর্ক ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ঐ যুদ্ধে বাংলাদেশকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেছিল।

২০০৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় ফিরে আসার পরপরই শেখ হাসিনা পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য রাশিয়ার সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এটি বাংলাদেশে গৃহীত সবচেয়ে ব্যয়বহুল অবকাঠামো প্রকল্প, যা দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে মজবুত করেছে।

এরপর ২০১৪ এবং ২০০১৮ সালে বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়ে ভ্লাদিমির পুতিন তার প্রতিদান দিয়েছিলেন।

পাশ্চাত্যের দেশগুলো ২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির সমালোচনা করেছিল। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও এর মিত্ররা ২০১৪ সালের নির্বাচন বয়কট করে।

এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ৬৯ টি রাশিয়ান মাদার ভেসেলকে ঢুকতে না দেওয়ার জন্য সমস্ত বন্দর এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করার পরে, রোসাটম নিউক্লিয়ার কর্পোরেশনের বক্তব্য উদ্ধৃত করে তাস বলেছিল, বাংলাদেশে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র (এনপিপি) নির্মাণ সময়মতো সম্পন্ন করার প্রয়োজনে বিকল্প পথে রাশিয়ার জাহাজে করে পণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে।

“বর্তমান সময়সূচি অনুসারে এনপিপি নির্মাণ অব্যাহত রয়েছে। কার্গো সরবরাহের জন্য একটি বিকল্প পথ পাওয়া গেছে এবং এই মুহূর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে,” জানায় রাশিয়ার রাষ্ট্র-চালিত কর্পোরেশন রোসাটম।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশে রোসাটমের একজন কর্মকর্তা বেনারকে বলেন, “রোসাটম বিমানের মাধ্যমে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কিছু হালকা সরঞ্জাম পাঠানোর পরিকল্পনা করছে।”

“বেশিরভাগ ভারী উপকরণ ইতিমধ্যে চলে এসেছে। প্রয়োজনে কোম্পানি এমন জাহাজ ব্যবহার করবে যা ভবিষ্যতে নিষেধাজ্ঞার বাইরে থাকবে,” তিনি বলেন।

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে আগ্রাসনের পর পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার তাদের সমালোচনা করেন এবং রূপপুরে পারমাণবিক প্রকল্পে এগিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।