যুদ্ধ পরিস্থিতিতে রাশিয়ার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবিরতায় উদ্বিগ্ন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা

কামরান রেজা চৌধুরী
2022.03.24
ঢাকা
যুদ্ধ পরিস্থিতিতে রাশিয়ার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবিরতায় উদ্বিগ্ন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা গাজীপুরের একটি গার্মেন্টস কারখানায় কাজ করছেন শ্রমিকরা। ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১। যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে রাশিয়ায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি বাধার মুখে পড়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
[রয়টার্স]

রাশিয়ার আর্থিক লেনদেনের ওপর চলমান নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশটির সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা।

এ বিষয়ে দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বেনারকে বলেন, বিভিন্ন দেশের বন্দর কর্তৃপক্ষ রাশিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়া বাংলাদেশি রপ্তানি পণ্যগুলি অফলোড করছে। আবার রাশিয়ার গ্রাহকদের জন্য পোশাকের অর্ডার দেওয়া অনেক আন্তর্জাতিক চেইনও রাশিয়ায় তাদের আউটলেট বন্ধ করার কারণে অর্ডার বাতিল করেছে।

তবে বাংলাদেশে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেক্সান্ডার মান্টিটস্কি বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন, সুইফট সিস্টেম এড়িয়ে লেনদেন ও বাণিজ্য নিরবচ্ছিন্ন রাখার জন্য বিকল্প পদ্ধতি অনুসন্ধান করছে বাংলাদেশ ও রাশিয়া।

“গত সপ্তাহে মস্কোতে বাংলাদেশ দূতাবাস বার্টার বাণিজ্যের (পণ্যের বিনিময়ে পণ্য, যা বার্টার বা কাউন্টার ট্রেড নামে পরিচিত) বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া যায় কি না, প্রস্তাব দিয়েছে,” বলেন তিনি।

“আমি এটুকু বলতে পারি, দুই দেশ ব্যবসা ও লেনদেন অব্যাহত রাখার স্বার্থে বার্টার, এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের মুদ্রা বিনিময় (রুবল ও টাকার মধ্যে) এবং তৃতীয় দেশের ব্যাংক ব্যবহারের মতো বিকল্পগুলো নিয়ে আলোচনা চলছে,” বলেন আলেক্সান্ডার মান্টিটস্কি।

ইউক্রেনে রাশিয়ার ‘বিশেষ সামরিক অভিযানের’ এক মাস পূর্তি উপলক্ষে ঢাকার রাশিয়া দূতাবাস এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে।

যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বেনারকে বলেন, তারা রাশিয়া ও বাংলাদেশের মধ্যে মুদ্রা বিনিময়ের কোনো প্রস্তাব পাননি।

“আমরা রাশিয়া-ইউক্রেন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। পরিস্থিতি বুঝে আমরা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব,” জানান সিরাজুল ইসলাম।

সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন (সুইফট) হচ্ছে ব্রাসেলসভিত্তিক আন্তঃব্যাংক আর্থিক লেনদেনের বার্তা প্রেরণের একটি সুরক্ষিত নেটওয়ার্ক। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পাশ্চাত্যের মিত্ররা সুইফট ব্যবস্থায় রাশিয়ার আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।

এর ফলে রাশিয়া অর্থ স্থানান্তরের জন্য আন্তর্জাতিক পদ্ধতি সুইফট ব্যবহার করতে পারছে না। এতে বাংলাদেশের সঙ্গে রাশিয়ার লেনদেনে এক ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

বাণিজ্য ‘অনেকটাই স্থবির

বাংলাদেশ-রাশিয়ার বাণিজ্য অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছে বলে জানান এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন।

“আমরা বছরে রাশিয়ায় ৭০০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করি। দুই দেশের মধ্যে বছরে বাণিজ্যের পরিমাণ এক বিলিয়ন ডলারের বেশি। নিষেধাজ্ঞার কারণে স্বাভাবিক বাণিজ্য ব্যাহত হচ্ছে।”

“কিন্তু সরকার এ বিষয়ে এখনও বিকল্প বাণিজ্যের উপায় বের করতে পারেনি, এ কারণে আমরা সত্যিই উদ্বিগ্ন,” যোগ করেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে আলেক্সান্ডার মান্টিটস্কি বলেন, “ওয়াশিংটনের নিষেধাজ্ঞা শুধু রাশিয়া একা নয়, বাংলাদেশসহ দেশটির মিত্রদের জন্যও হুমকি তৈরি করেছে। এ পরিস্থিতি সামাল দিয়ে নির্বিঘ্নে বহুমাত্রিক সহযোগিতা এগিয়ে নিতে ঢাকা ও মস্কোর মধ্যে আলোচনা হচ্ছে।”

রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত জানান, রাশিয়া বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য কমানো নয়, বাড়াতে আগ্রহী। এ মুহূর্তে পশ্চিমা অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের সরকারের চাপে রাশিয়া থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে।

রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত বলেন, “অবিশ্বস্ত অংশীদারেরা দূরে সরে গিয়ে আমাদের বাংলাদেশের অংশীদারদের জন্য এক দারুণ সুযোগ তৈরি করেছে।”

যদিও বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা চলমান পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।

ইয়ংফরএভার টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাজিব চৌধুরী বেনারকে বলেন, তিনি রাশিয়ায় পোশাকের চালান পাঠালেও একটি বন্দরে তা তিন সপ্তাহ ধরে পড়ে আছে।

“এখন রাশিয়ায় আমার ক্রেতারা বলছেন, তারা লাটভিয়া বন্দর থেকে এটি গ্রহণ করার চেষ্টা করছেন।”

রাশিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ মূলত অ্যাপারেল আইটেমস, পাট, হিমায়িত খাদ্য, চা, চামড়া ও সিরামিক পণ্য রপ্তানি করে।

ওয়েবসাইটে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে খনিজ, রাসায়নিক পণ্য, প্লাস্টিক সামগ্রী, ধাতু, যন্ত্রপাতি, শুকনা খাবারসহ বেশকিছু পণ্য আমদানি করে।

বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা

সংবাদ সম্মেলনে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত বলেন, “জাতিসংঘের জরুরি অধিবেশনে ভোটাভুটির আগে বাইরের প্রবল চাপ সত্ত্বেও বাংলাদেশ নিরপেক্ষতা বজায় রাখায় আমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।”

গত ২ মার্চ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের জরুরি অধিবেশনের এক প্রস্তাবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকে বাংলাদেশ। ওই প্রস্তাবের বিষয়ে বাংলাদেশের দায়িত্বশীল ও ভারসাম্যপূর্ণ আচরণের প্রশংসা করে রাশিয়া।

এক প্রশ্নের উত্তরে আলেক্সান্ডার মান্টিটস্কি বলেন, “আমরা বুঝতে পারি, বর্তমান পরিস্থিতির কারণে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে বাংলাদেশের দুশ্চিন্তা রয়েছে। এখন পর্যন্ত সব কাজ নির্ধারিত সময় ধরেই এগোচ্ছে। কাজেই প্রকল্প শেষ করার জন্য আগে যে সময়সীমা ঠিক করা হয়েছিল, সে অনুযায়ী তা শেষ হবে।”

গম ও জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ব্যাখ্যা

রাশিয়া থেকে কেনা গম ও জ্বালানির দাম বাড়ার বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে আলেক্সান্ডার মান্টিটস্কি বলেন, “একটা বিষয় স্পষ্ট করেই বলছি, সরবরাহের বিষয়ে রাশিয়ার যে বাধ্যবাধকতা, সেটা পূরণ করা হবে। বাড়তি চাহিদা নিয়ে মধ্যস্বত্ত্বভোগী ও কিছু গণমাধ্যম জনগণের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে দেওয়ায় এখানে পণ্যের মূল্য বেড়ে গেছে।”

“রাশিয়া ও বেলারুশের ওপর সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে বিশ্বজুড়ে সারের মূল্য ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। সারা বিশ্বে পটাশ সারের প্রধান যোগানদাতা রাশিয়া ও বেলারুশ, যা কৃষির অন্যতম প্রধান উপাদান,” বলেন তিনি।

পাশ্চাত্যের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারবে না উল্লেখ করে আলেক্সান্ডার মান্টিটস্কি বলেছেন, “ইতিহাসের নানা পর্বে সংকট মোকাবিলা করেই রাশিয়া এগিয়েছে। এখনকার পরিস্থিতি ভালোভাবে মোকাবিলা করে ঘুরে দাঁড়াবে রাশিয়া।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।