রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরে গুরুত্ব পাবে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও রাজনীতি
2023.08.22
ঢাকা
নির্মাণাধীন প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণের সুদ পরিশোধের উপায় বের করাসহ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে এই প্রথম বাংলাদেশ সফরে আসছেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মহাপরিচালক সেহেলী সাবরিন মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, আগামী ৭ সেপ্টেম্বর দুই দিনের সফরে ঢাকায় আসছেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ। এটি একটি দ্বিপাক্ষিক সফর।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ল্যাভরভের সফরে আলোচ্যসূচির মধ্যে রয়েছে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থায় বাংলাদেশের সমর্থন আদায় করা।
এ ছাড়া ১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য নেওয়া অর্থের সুদ পরিশোধের উপায় নিয়ে দুই পক্ষের আলোচনা হবে।
এ বছরের শেষে অথবা আগামী বছর শুরুতে বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দ্বিপাক্ষিক টানাপোড়েনের মধ্যেই ঢাকা সফর করছেন পশ্চিমাদের কঠোর সমালোচক এই রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর অবস্থানকে “বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর সামিল” বলে সমালোচনা করেছে রাশিয়া।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত রাশিয়ার কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করেননি। ল্যাভরভই হবেন বাংলাদেশ সফরকারী প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
গত বছর ঢাকায় অনুষ্ঠিত ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর সংগঠন আইওরা সম্মেলনে যোগ দিতে ২৩ নভেম্বর ঢাকা সফরে আসার কথা ছিল ল্যাভরভের। শেষ মুহূর্তে সফরটি বাতিল হয়।
সে সময় রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছিল, সুবিধাজনক সময়ে তিনি বাংলাদেশ সফর করবেন।
রাশিয়ার সমর্থন কামনা করে বাংলাদেশ
নিরাপত্তা পরিষদের বর্তমান চেয়ার রাশিয়া। ইউক্রেন থেকে হাজার হাজার ইউক্রেনীয় শিশুকে জোর করে বাবা-মায়ের কাছ থেকে ছিনিয়ে রাশিয়ায় নিয়ে যাওয়া এবং যুদ্ধাপরাধে রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকায় তাঁর পরিবর্তে বিভিন্ন দেশ সফর ও আন্তর্জাতিক ফোরামে রাশিয়ার প্রতিনিধিত্ব করছেন ল্যাভরভ।
দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে চলা ব্রিকস সম্মেলনে পুতিনের পরিবর্তে রাশিয়ার প্রতিনিধিত্ব করছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনকে আক্রমণ করার কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ করে, পশ্চিমা দেশগুলো কূটনৈতিকভাবে রাশিয়াকে বয়কট করে আসছে।
বর্তমানে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অনেকটাই কোণঠাসা মস্কো। এপ্রিল মাসে শেখ হাসিনার জাপান সফরের যৌথ বিবৃতিতে ইউক্রেন যুদ্ধের মাধ্যমে সব আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে প্রথমবারের মতো রাশিয়ার সমালোচনা করে বাংলাদেশ।
রাজনৈতিক অঙ্গন ছাড়াও বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থায় থেকেও অনেকটা ছিটকে পড়েছে রাশিয়া।
সারা বিশ্বে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ব্যবহৃত মেসেজিং সিস্টেম সুইফট থেকে রাশিয়ার ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে বের করে দেওয়া হয়েছে।
রাশিয়ার অনেক ব্যাংক মার্কিন অবরোধের মধ্যে রয়েছে। অর্থাৎ এসব ব্যাংকের সঙ্গে ব্যবসা করলে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোও মার্কিন অবরোধের মধ্যে পড়তে পারে।
এ কারণে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য রাশিয়া থেকে নেওয়া ঋণের বিপরীতে সুদ পরিশোধ করতে পারছে না বাংলাদেশ।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে পশ্চিমা দেশগুলোর অবরোধপ্রাপ্ত রাশিয়ার এসবারব্যাংকের (SBERBANK) একটি শাখা খুলতে বাংলাদেশ ব্যাংক বরাবর আবেদন করেছে রাশিয়া। তবে এ ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্তে দেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর সম্পর্কে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মুহাম্মদ ফারুক খান মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “এতদিন রাশিয়ার কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করেননি, এখন করছেন। এর অর্থ হলো—রাশিয়ার মতো সুপার পাওয়ার বাংলাদেশকে গুরুত্ব দিচ্ছে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে।”
তিনি বলেন, “তিনি এমন সময় এই সফর করছেন যখন বাংলাদেশে নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক শক্তির তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। আমরা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিষয়ে রাশিয়ার সমর্থন কামনা করি।”
ল্যাভরভের সফরে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের চেষ্টা চালাতে রাশিয়াকে অনুরোধ জানানো হতে পারে জানিয়ে ফারুক খান বলেন, “ইউক্রেন যুদ্ধ বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে আফ্রিকার দেশগুলোতে, মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকটের সৃষ্টি করেছে। যুদ্ধবিরোধী দেশ হিসেবে এই যুদ্ধ বন্ধ করতে আমরা আহ্বান করে যাব।”
পশ্চিমারা ‘সজাগ নজর রাখবে’
সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করবেন ল্যাভরভ।
ল্যাভরভের এই সফরকে পশ্চিমা দেশগুলো ভিন্নভাবে দেখবে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন বেনারকে বলেন, “আমার মনে হয় না পশ্চিমা দেশগুলো এই সফর নিয়ে সন্দেহের চোখে দেখবে। তবে এই সফরের কী কী আলোচনা হচ্ছে এবং কী সিদ্ধান্ত হচ্ছে সে বিষয়ে তারা সজাগ নজর রাখবে।”
তিনি বলেন, “রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সফর করার আগ্রহ প্রকাশ করলে বাংলাদেশ তো আর তা প্রত্যাখ্যান করতে পারে না। এটি পশ্চিমারা বোঝে।”
রাশিয়ার কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করেননি জানিয়ে তৌহিদ হোসেন বলেন, “বাংলাদেশের সঙ্গে রাশিয়ার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ভালো। তবে সেটি পশ্চিমা দেশগুলোর মতো ব্যাপক নয়।
তিনি বলেন, “রাশিয়ার সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা তেমন নেই। কারণ আমরা মিগ-২১ কেনার পর আর কোনো সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় করিনি। সহযোগিতার অন্যতম ক্ষেত্র হলো রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ এবং জ্বালানি খাতে রাশিয়ার কোম্পানির অংশগ্রহণ।”
তৌহিদ হোসেন বলেন, “আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যেমন রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশকে সমর্থন দেয় না রাশিয়া। রাশিয়া স্পষ্টতই মিয়ানমারের পক্ষে।”
“বাংলাদেশের অর্থনীতিসহ অনেক কিছুই পশ্চিমা অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল। আমি মনে করি না, বাংলাদেশের জন্য পশ্চিমা দেশগুলোর বিকল্প হতে পারে রাশিয়া,” মত দেন তিনি।