রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র: রাশিয়া থেকে বিমানে করে জ্বালানি পৌঁছাল বাংলাদেশে
2023.09.29
ঢাকা
রাশিয়া থেকে বিশেষায়িত কার্গো বিমানে বাংলাদেশের একমাত্র পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য প্রথম ইউরেনিয়ামের চালান শুক্রবার পাবনার রূপপুরে পৌঁছেছে।
বিদ্যুৎ প্রকল্পটির প্রথম ইউনিটে ব্যবহারের জন্য এই জ্বালানি রাশিয়ার সাইবেরিয়া থেকে “একটি বিশেষ কার্গো উড়োজাহাজে” ঢাকায় আসার পর সেখানে থেকে “বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থায় আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুযায়ী” শুক্রবার রূপপুরে পৌঁছায় বলে বেনারকে জানান রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের পরিচালক ড. শৌকত আকবর।
প্রকল্পের দু’টি ইউনিটের মধ্যে প্রথমটির কাজ সম্পূর্ণ এবং দ্বিতীয়টির রিঅ্যাক্টর স্থাপনসহ মূল কাজ “প্রায় শেষ” জানিয়ে তিনি বলেন, “আশা করছি, আগামী বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যে আমরা এখান থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করতে পারব।”
আগামী ৫ অক্টোবর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনলাইনে দুই দেশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যুক্ত হবেন। তখনই আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের কাছে রাশিয়া ইউরেনিয়াম হস্তান্তর করবে বলে জানান শৌকত আকবর।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পশ্চিমা বিশ্বের প্রায় সব দেশ রাশিয়াকে এড়িয়ে চলছে, একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে। পাশাপাশি, আসন্ন সংসদ নির্বাচন নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠান করা নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের ওপরও পশ্চিমাবিশ্বের চাপ রয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে, প্রধানমন্ত্রী রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের সাথে অনলাইন যুক্ত হয়ে ইউরেনিয়াম হস্তান্তরের আনুষ্ঠানিকতা কতটা যুক্তিযুক্ত এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান মুহাম্মদ ফারুক খান শুক্রবার বেনারকে বলেন, “পশ্চিমারা কী ভাবল তা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই।”
“বাংলাদেশে নতুন প্রযুক্তি সংযোজনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অগ্রাধিকারের প্রতীক রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রাশিয়া সহযোগিতা করেছিল।
“রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশ ও রাশিয়ার জনগণের বন্ধুত্বের প্রতীক,” বলেন ফারুক খান।
প্রকল্পটি অর্থনৈতিকভাবে ‘গ্রহণযোগ্য নয়’
বিশ্লেষকদের মতে এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পটি “দেশের জন্য একটি ‘বোঝা’ হতে পারে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলামের মতে, প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার দিয়ে দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন “অর্থনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।”
রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের মাধ্যমে “দেশের সম্পদ নষ্ট হবে” মন্তব্য করে শুক্রবার তিনি বেনারকে বলেন, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে রাশিয়াকে প্রতি বছর ৫৬০ মিলিয়ন ডলার করে ঋণ শোধ করতে হবে, “এই প্রকল্প জাতির জন্য একটি বোঝা।”
বাংলাদেশের জন্য “এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সঠিক সিদ্ধান্ত নয়,” বলেন অধ্যাপক মইনুল।
প্রকল্পের নথি অনুসারে, রূপপুর প্রকল্পের মোট খরচ ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে রাশিয়া সরকার ঋণ হিসেবে দিয়েছে ১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ সরকারের ব্যয় এক দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার।
সুদের হার এক দশমিক ৭৫ এবং গ্রেস পিরিয়ড ১০ বছর। ২০২৭ সাল থেকে বাংলাদেশকে ঋণের মূল টাকা ২০টি ভাগে শোধ করতে হবে। পাশাপাশি, প্রকল্প চলাকালে যে পরিমাণ অর্থ খরচ হবে তার বিপরীতে প্রতি বছর দুই বার সুদ দিতে হবে। সেই টাকা বাংলাদেশ পরিশোধ করে যাচ্ছে।
যোগাযোগ করা হলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আ.ফ.ম. রুহুল হক শুক্রবার বেনারকে বলেন, “ইউরেনিয়াম চলে এসেছে—অর্থ হলো আমরা অচিরেই পারমাণবিক বিদ্যুৎ পাব। এটি দেশের জন্য একটি বড়ো অর্জন।”
তিনি বলেন, “সমালোচনা থাকবে। বাংলাদেশ পারমাণবিক ক্লাবে যুক্ত হয়েছে এবং এই প্রকল্পের মাধ্যমে পারমাণবিক বিজ্ঞানীসহ দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে পারবে।”
বিদ্যুৎকেন্দ্রটি থেকে বিদ্যুৎ পাবার জন্য সরবরাহ লাইন এখনো নির্মাণাধীন বলে বেনারকে জানান সরকারের পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন।
তিনি বলেন “রূপপুর থেকে ২০২৫ সালে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে।
প্রকল্পের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে, ২০০৯ সালের ১৩ মে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন এবং রাশিয়ার পারমাণবিক শক্তির মূল কর্তৃপক্ষ রোসাটমের মধ্যে ‘পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার’ বিষয়ক একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।
২০১১ সালের ২ নভেম্বর রূপপুরে প্রতিটি এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষম দুই ইউনিট বিশিষ্ট পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন সংক্রান্ত সহযোগিতা চুক্তি হয় দুই দেশের মধ্যে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রস্তুতিমূলক পর্যায়ের নির্মাণ কাজের জন্য ২০১৩ সালের ১৫ জানুয়ারি ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি ঋণ সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ ও রাশিয়া।
প্রকল্প বাস্তবায়নে দুই দেশের মধ্যে ১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ প্রদান সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুসারে, প্রকল্পের ভৌত অবকাঠামোর প্রায় সব এবং কারিগরি সব কাজ রাশিয়ান ঠিকাদাররা করছে। বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ শুধু কাজগুলো বুঝে নিয়ে সনদ প্রদান করছে। সেই সনদের ভিত্তিতে রাশিয়া সরকার ঠিকাদারদের পাওনা পরিশোধ করছে। রাশিয়া কোনো বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশে পাঠাচ্ছে না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের এক নম্বর ইউনিটের প্রথম কংক্রিট ঢালাই কাজের উদ্বোধন করেন। বর্তমান সরকারের ১০টি মেগা প্রকল্পের একটি হচ্ছে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র।
রাশিয়ার ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্যাংশন আরোপ করায় রূপপুর প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ, যন্ত্রপাতি আনাসহ বিভিন্নকাজে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয় রাশিয়া ও বাংলাদেশ।
গত ডিসেম্বরে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য মালামাল নিয়ে আসা একটি রাশান জাহাজে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থাকায় বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। এর পরে শুক্রবার বিমানে করে প্রকল্পের জন্য জ্বালানি এলো রাশিয়া থেকে।