গোপন বন্দিশালা ‘আয়নাঘরের’ প্রমাণ পেয়েছে কমিশন
2024.10.03
ঢাকা
‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিত গোপন বন্দিশালা নিয়ে এতদিন নানা আলোচনা ও বিতর্ক চলে আসলেও এই প্রথম সরকারের গঠিত কমিশন অভিনব এই টর্চার সেলের কথা প্রকাশ করেছে। সেনা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের তত্ত্বাবধানে এ ধরনের ২২টি কক্ষ সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন কমিশনের সদস্যরা।
আওয়ামী লীগ আমলে গুমের ঘটনা তদন্তে গঠিত এই কমিশন বৃহস্পতিবার ঢাকার গুলশানে গুম সংক্রান্ত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে গোপন বন্দিশালার অস্তিত্ব পাওয়ার কথা স্বীকার করে।
তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান ও হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ব্রিফিংয়ে জানান, “রাজধানীর কচুক্ষেত এলাকায় ডিজিএফআই সদর দপ্তরের ভেতরে অবস্থিত এই জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেল (জেআইসি) 'আয়নাঘর' নামে পরিচিত। দোতলা ভবনটিতে প্রায় ২২টি সেল রয়েছে যা আটক কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহৃত হতো।”
এ বিষয়ে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর-আইএসপিআরের বক্তব্য জানতে যোগাযোগ করা হলে তাদের কোনো বক্তব্য নেই বলে বেনারকে জানানো হয়।
ড. ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর গত ২৭ আগস্ট আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিভিন্ন সরকারি বাহিনী কর্তৃক বলপূর্বক অপহরণ ও গুমের ঘটনা তদন্তের জন্য পাঁচ সদস্যের কমিশন গঠন করা হয়।
বৃহস্পতিবার ব্রিফিংকালে বিচারপতি মইনুল সাংবাদিকদের বলেন, কমিশন কাজ শুরু করার পর গত ১৩ কার্যদিবসে তাদের কাছে মোট ৪০০টি অভিযোগ জমা পড়েছে। এরপর কমিশন ডিজিএফআই কার্যালয়ে যায়।
এসব অভিযোগের অধিকাংশই র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি), সেনাবাহিনীর ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই) এবং পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) বিরুদ্ধে।
“আমরা ২৫ সেপ্টেম্বর আয়নাঘর এবং ১ অক্টোবর ডিবি ও সিটিটিসি চত্বরে গিয়েছিলাম। সেখানে কোনো আটক ব্যক্তিকে আমরা খুঁজে পাইনি। আমরা মনে করি ৫ আগস্টের পর তাঁদের সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হতে পারে,” মইনুল বলেন।
কমিশনের প্রধান বলেন, “যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে তাদেরও আমরা ডাকব এবং তারা কমিশনের সামনে হাজির না হলে ব্যবস্থা নেব।"
বিচারপতি মইনুল বলেন, "প্রায় ৭৫ জন নিখোঁজের শিকার ব্যক্তি সশরীরে আমাদের কাছে এসেছিলেন এবং আমরা তাঁদের বিবৃতি রেকর্ড করেছি। অনেক অভিযোগ পোস্ট এবং ই-মেইলের মাধ্যমেও পাঠানো হয়েছে। প্রয়োজনে অভিযোগ গ্রহণের সময়সীমা আবার বাড়ানো হবে।”
তাঁরা তিন মাসের মধ্যে তদন্ত প্রক্রিয়া শেষ করতে পারবেন কি না জানতে চাইলে আগামী দিনে তা নির্ধারণ করা হবে বলেও জানান তিনি।
বিচারপতি মইনুল বলেন, কমিশন সাবেক সেনা কর্মকর্তা আবদুল্লাহিল আমান আজমি এবং সাবেক বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হুমাম কাদের চৌধুরীর জবানবন্দি রেকর্ড করেছে।
সরকার পতনের পর কথিত ‘আয়নাঘর’ থেকে মুক্তি পেয়েছেন ব্যারিস্টার আহমেদ বিন কাশেম আরমান, সাবেক সেনা কর্মকর্তা আব্দুল্লাহিল আমান আজমি ও মাইকেল চাকমা। বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকার তাঁরা তাদের ওপর চলা নির্যাতনের বর্ণনা তুলে ধরেন।
গুম কমিশনের প্রধান বিচারপতি মইনুল বলেন, গুমের শিকার ব্যক্তিদের অভিযোগ তাঁদেরকে র্যাব, ডিবি অথবা সিটিটিসি সদস্যরা তুলে নিয়ে যাওয়ার পর দিনের পর দিন এবং বছরের পর বছর আটকে রেখেছিল।
আয়নাঘর অপরিবর্তিত রাখার নির্দেশ
তদন্ত কমিশনের সদস্য সাজ্জাদ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, “পরিদর্শনকালে আমরা গোপন বন্দিশালা আয়নাঘরে যা দেখেছি তার সাথে ভুক্তভোগীদের বর্ণনা মিলে গেছে। তবে তাদের মুখে সেলগুলোর যে বর্ণনা শুনেছি, তার অনেকটাই এখন নেই।”
এর ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, “ভুক্তভোগীরা বলেছিল দেয়ালে তাদের অনেক কথা, নাম এগুলো লেখা ছিল। অনেকের ফোন নম্বর, অনেকের ঠিকানা লেখা ছিল। দেয়ালে রং করার কারণে সেসব আর আমরা পাইনি। গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পরপরই এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে বলে আমাদের ধারণা।”
আলামত যাতে আর নষ্ট না হয় সেজন্য মৌখিক এবং লিখিতভাবে ডিজিএফআইকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান সাজ্জাদ হোসেন।
তিনি বলেন, “আমরা যে অবস্থায় আয়নাঘর পেয়েছি, তা যেন তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত পরিবর্তন করা না হয়।”
কমিশনের সদস্য মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা সবার অভিযোগ শুনতে চাই এবং সেখানে কী হয়েছে তা জানতে চাই। আইন লঙ্ঘন করে কীভাবে তাদের কারাগারে রাখা হয়েছে তা আমরা বুঝতে চাই।”
কমিশনের সদস্য ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নাবিলা ইদ্রিস বলেন, আগে থানায় সাধারণ ডায়েরি না করায় বেশিরভাগ অভিযোগই নতুন।
তিনি বলেন, "আমরা সব অপহরণ ও গুমের শিকার এবং পরিবারকে অভিযোগ দায়ের করার আহ্বান জানাই।"
এক প্রশ্নের জবাবে কমিশনের সভাপতি মইনুল বলেন, সব অপহরণই বলপূর্বক গুম নয়, সব গুমই অপহরণ।
ঘটনার বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, কমিশন সরকারকে ১৮৬০ সালের পেনাল কোড সংশোধন করার পরামর্শ দেবে। কারণ, বলপূর্বক গুমের বিরুদ্ধে মামলার জন্য কোনো দণ্ডবিধি নেই।
বিচারপতি মইনুল জানান, কমিশনকে প্রাথমিকভাবে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু কাজের পরিধি বিবেচনা করে কমিশন ১০ অক্টোবর পর্যন্ত সময়সীমা বাড়িয়েছে। প্রয়োজনে সময় আরও বাড়ানো হতে পারে।
গুমের শিকারের সংখ্যা ৭শ’র বেশি
মানবাধিকার কর্মী নূর খান বেনারকে বলেন, মানবাধিকারকর্মীরা বলতেন বলপূর্বক অপহরণ ও গুমের শিকারের সংখ্যা প্রায় ৭০০, কিন্তু এখন তারা ভাবছেন সংখ্যাটা আরও বেশি হবে।
“আমরা এখন ভুক্তভোগী এবং তাদের পরিবারের কাছ থেকে কিছু অভিযোগ পাচ্ছি যারা আগে কোনো অধিকার গোষ্ঠীর সাথে যোগাযোগ করেনি। তাই আমরা মনে করি গুমের শিকারের সংখ্যা বাড়বে,” তিনি বলেন।
তিন ধরনের ভুক্তভোগী আছে উল্লেখ করে নূর খান বলেন, কেউ কেউ কয়েক বছর ধরে নিখোঁজ থাকার পরে ফিরে এসেছেন, কেউ কেউ এখনও নিখোঁজ এবং অনেককে কয়েক মাস নিখোঁজ থাকার পরে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
গোপন বন্দিশালায় আর কোনো লোক আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমাদের জানামতে আয়নাঘরে এখন কোনো ভিকটিম নেই।”