মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের জন্য কনডেম সেল নিষিদ্ধ করেছে হাইকোর্ট
2024.05.13
ঢাকা
বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা হলেই জেলখানার নির্জন বসতি কনডেম সেলে পাঠিয়ে দেয়ার বিধানকে বেআইনি ঘোষণা করেছে হাইকোর্ট।
বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি মো. বজলুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ তিন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির করা রিট আবেদন নিষ্পত্তি করে সোমবার এই রায় দেন বলে বেনারকে নিশ্চিত করেছেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত তালুকদার।
হাইকোর্টের এই রায়কে ‘ঐতিহাসিক’ বলে আখ্যায়িত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলেন, দেশের বিদ্যমান ব্যবস্থায় বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডের রায়ের পরপরই আসামিকে কনডেম সেলে রাখা হয়, যেখানে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের মাধ্যমে চূড়ান্ত রায়ের মাধ্যমে বিচার শেষ হতে ১০ থেকে ১২ বছর সময় লেগে যায়।
আদালতের রায়ের বিষয়ে রিটকারীর আইনজীবী মুহাম্মদ শিশির মনির বেনারকে বলেন, হাইকোর্ট বলেছে মৃত্যুদণ্ডের আগে দীর্ঘ নির্জন কারাবাস দ্বৈত সাজার শামিল।
তিনি বলেন, আদালত বলেছে, “এটিকে সংবিধান ও ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা স্বীকৃতি দেয় না। তাই বর্তমানে যেসব আসামি কনডেম সেলে রয়েছেন তাঁদের আগামী দুই বছরের মধ্যে সাধারণ বন্দিদের সঙ্গে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”
আদালত অবশ্য বলেছে, যাদের সংক্রামক বা অন্যান্য শারীরিক অসুস্থতা রয়েছে তাঁরা তাঁদের সম্মতিতে আলাদা থাকতে পারবেন, জানান আইনজীবী মনির।
তিনি জানান, হাইকোর্ট সংশ্লিষ্ট আদালতকে অন্যান্য সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের মতো মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের জামিন আবেদনের শুনানির জন্যও বলেছে, যদিও হাইকোর্ট বিভাগ বর্তমানে এই ধরনের জামিন আবেদনের শুনানি করে না।
বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড দিলেই কাউকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি বলা যাবে না, এমন নির্দেশনা দিয়ে আদালত বলেছে, হাইকোর্ট বিভাগ, আপিল বিভাগ ও রাষ্ট্রপতির কাছে করা আবেদন খারিজ হওয়ার পরই কেবল মাত্র বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ হয়। এই প্রক্রিয়াগুলোর পরে কারও মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকলেই তাঁকে কনডেম সেলে রাখা যেতে পারে।
দীর্ঘদিন ধরে মৃত্যুদণ্ড নিয়ে গবেষণা করা এই আইনজীবী বলেন, বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের প্রায় অর্ধেকই উচ্চ আদালত থেকে খালাস পেয়ে যান।
রায়ের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন নিজ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বিষয়টি নিয়ে তিনি সরকারের সঙ্গে আলোচনা করবেন।
তিনি বলেন, “আমরা এই রায়কে সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করব কি না, সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
কারা অধিদপ্তরের উপ-মহাপরিদর্শক মনির আহমেদ বেনারকে বলেন, আদালতের রায়ের সার্টিফাইড কপি পাওয়ার পর কারা কর্তৃপক্ষ রায়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
“আমরা গণমাধ্যমে জেনেছি যে হাইকোর্ট এমন একটি রায় ঘোষণা করেছেন। এখন আমাদের বিস্তারিত জানতে হবে এবং অবশ্যই আমরা আদালতের প্রতি সম্মান দেখাব,” যোগ করে মনির।
চট্টগ্রাম, সিলেট ও কুমিল্লা কারাগারের তিনজন বন্দি বিচার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হওয়ার আগে দণ্ডিতদের কনডেম সেলে রাখার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালের ২ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টে একটি রিট করেন।
রিটের শুনানির পর, হাইকোর্ট পরের বছরের এপ্রিলে একটি রুল জারি করে, সরকারকে জিজ্ঞাসা করে যে বিচার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হওয়ার আগে আসামিদের কনডেম সেলে আটক কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না এবং দণ্ডবিধির ৯৮০ ধারা কেন বাদ দেওয়া হবে না?
কারা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা আট ফুট বাই ৮ ফুটের একটি ঘরে থাকেন, যেখানে ঘরের ভেতরেই একটি ছোট বাথরুম রয়েছে যার কোনো দরজা নেই। এই বন্দিরা ঘরের বাইরে যেতে পারেন না।
অধিদফতরের তথ্যে দেখা গেছে, দেশের কারাগারগুলোতে বর্তমানে দুই হাজার ৫৫৪ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দি রয়েছেন যারা কনডেম সেলে বসবাস করছেন।
এই বন্দিদের মধ্যে দুই হাজার ৪৬৮ জন পুরুষ এবং বাকি ৮৬ জন নারী।
‘ঐতিহাসিক রায়’
হাইকোর্টের রায়কে স্বাগত জানিয়ে বাংলাদেশের মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক এ রায়কে ‘ঐতিহাসিক’ বলে অভিহিত করেছেন।
তিনি বেনারকে বলেন, “অধিকাংশ মৃত্যুদণ্ডের মামলা বিচারের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাতে ১০ থেকে ১২ বছর সময় লেগে যায়। কিন্তু এতদিন বন্দিকে নির্জন জায়গায় রাখা খুবই অমানবিক।”
তিনি বলেন, অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টে বা রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে খালাসও পেয়েছেন। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে-এতগুলো বছর তাঁদের ‘অন্ধকার ঘরে’ আটকে রাখা কি চরম অমানবিক নয়?
কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার আগে তিনি দেশের বিচারিক আদালতগুলোকে আরও সতর্ক হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন।
বাংলাদেশের নিম্ন আদালতগুলোতে অধিকসংখ্যক ফাঁসি দেওয়ার ঘটনাগুলো বেশ আলোচিত।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় ২০২১ সালের ডিসেম্বর ২০ ছাত্রকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আদালত।
গত বছরের ১৪ আগস্ট গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর থানার একটি হত্যা মামলায় পাঁচ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছে ঢাকার একটি আদালত।
গত বছরের এপ্রিলে নাটোরের সিংড়ায় এক কলেজ ছাত্রীকে গণধর্ষণের মামলায় ৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আদালত।