সুদানে সংঘাত: আটকে পড়া বাংলাদেশিদের সৌদিতে সরিয়ে নিতে অনিশ্চয়তা
2023.04.26
ঢাকা
রক্তক্ষয়ী সংঘাতের মধ্যে সুদানে আটকে পড়া প্রায় ৫০০ বাংলাদেশিকে ৩০ এপ্রিলের মধ্যে সরিয়ে নিতে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। কবে নাগাদ তাঁদের সরিয়ে নেয়া সম্ভব হবে তা পরিষ্কার করে বলতে পারছেন না সেখানকার দূতাবাসের কর্মকর্তারা।
কারণ হিসাবে বলা হচ্ছে, সুদান বন্দর থেকে বাংলাদেশিদের বহনকারী জাহাজ সৌদি আরবের বন্দরে প্রবেশের তারিখ দিতে পারছে না দেশটি।
বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, সুদানে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের সুদান বন্দর থেকে সাগরপথে প্রতিবেশী দেশ সৌদি আরবে সরিয়ে নেয়া হবে।
মঙ্গলবার বিকেলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম তাঁর ফেসবুক পেজে দেওয়া স্ট্যাটাসে জানান, সুদানে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের অন্য দেশের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
দেশটির সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ চলাকালে গত ১৫ এপ্রিল সুদানের রাজধানী খার্তুমে অবস্থিত বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত তারেক আহমেদের বাসভবনে মেশিনগানের গুলি এসে পড়ে। তাছাড়া গোলাগুলিতে দূতাবাসও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এই অবস্থায় রাষ্ট্রদূতসহ দূতাবাসে কর্মকর্তারা নিরাপদ স্থানে সরে গেছেন।
মঙ্গলবার পর্যন্ত বাংলাদেশ দূতাবাসে কেউ প্রবেশ করতে পারেনি বলে টেলিফোনে বেনারকে জানিয়েছেন রাষ্ট্রদূত তারেক আহমেদ। তবে তারপরও বাংলাদেশিদের সরিয়ে নিতে কাজ করে যাচ্ছেন দূতাবাসের কর্মকর্তারা।
রাষ্ট্রদূত বেনারকে বলেন, “ইতোমধ্যে দেশে ফিরতে প্রায় পাঁচশ বাংলাদেশি দূতাবাসে নিবন্ধন করেছেন। আমরা তাঁদের দেশে ফেরাতে সব চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু সমস্যা হলো সৌদি কর্তৃপক্ষ আমাদের জন্য জাহাজ ভেড়ানোর কোনো তারিখ দিতে পারছে না। সে কারণে আগ্রহী বাংলাদেশিদের তাঁদের নিজ নিজ স্থান থেকে পোর্ট সুদানে নেওয়া হয়নি।”
তিনি বলেন, “আমরা যা খবর পাচ্ছি তা হলো দেশ ছাড়তে পোর্ট সুদানে বিপুলসংখ্যক মানুষ জড়ো হয়েছেন। সেখানে হোটেল নেই, খাবার, নেই, পানি নেই, থাকার জায়গা নেই, পর্যাপ্ত টয়লেট নেই। সেখানে যাঁরা গেছেন তাঁরা পোর্ট সুদানের রাস্তাঘাটে রাত কাটাচ্ছেন।”
তারেক আহমেদ বলেন, “আমরা যদি বাংলাদেশিদের সেখানে নিয়ে যাই তাহলে তাঁদের আরেক দফা বিপদে ফেলা হবে। আমরা সেটি করতে চাই না।”
তিনি বলেন, “এই অবস্থায় ৩০ এপ্রিল সুদান থেকে বাংলাদেশিদের সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু সেখানে থেকে আমাদের হয়তো সরে আসতে হবে। সৌদি আরব কর্তৃপক্ষ সেদেশের বন্দরে জাহাজ ভেড়ানোর তারিখ জানানোর পরই আমরা বাংলাদেশিদের পোর্ট সুদানে নিয়ে যাব।”
রাষ্ট্রদূত বলেন, “ইতোমধ্যে খার্তুমে জ্বালানী সংকট তীব্র হয়েছে। যেই জ্বালানির দাম দুই হাজার সুদানি মুদ্রা সেই জ্বালানির মূল্য এখন ২০ হাজার। প্রতিদিনই জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা সমস্যায় আছি।”
সুদানে সর্বোচ্চ দেড় হাজার বাংলাদেশি রয়েছেন। তাঁরা ছোটখাটো কাজ করে থাকেন বলে জানান রাষ্ট্রদূত।
তিনি বলেন, “সুদানের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। আমি সরকারের কাছে চিঠি দিয়ে জানিয়েছি, যেন সুদানে বাংলাদেশিদের পাঠানো না হয়। এখানে কর্মীদের নিরাপত্তা দেয়া খুবই কঠিন।”
সংঘর্ষ থেকে রক্ষা করতে ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের দূতাবাসের কর্মকর্তা এবং নাগরিকদের সরিয়ে নিতে কাজ শুরু করেছে। সংঘর্ষ থেকে বাঁচতে লাখ লাখ মানুষ ভিড় করছে সুদান বন্দরে।
দেড় হাজার বাংলাদেশি
আফ্রিকার দেশ সুদানের অর্থনীতি মূলত সোনা রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল। সাড়ে চার কোটির বেশি জনসংখ্যার দেশটির রপ্তানির পরিমাণ প্রায় সাড়ে পাঁচ বিলিয়ন ডলার এবং বাৎসরিক গড় আমদানি ১২ বিলিয়ন ডলারের মতো। মাথাপিছু আয় ৮০০ ডলারের নিচে। সেখানে ভালো কর্মসংস্থান নেই বললেই চলে।
এছাড়াও, সুদানের আশেপাশের দেশগুলো সংঘাতময়। সেকারণে দেশটিতে ১১ লাখ শরণার্থী রয়েছে, যাঁদের শতকরা ৭৫ ভাগ দক্ষিণ সুদান থেকে আগত।
সেখানে সর্বোচ্চ দেড় হাজার বাংলাদেশি রয়েছেন যাঁদের খুব অল্প সংখ্যক একটি বাংলাদেশি কোম্পানিতে কাজ করেন। বাকিরা ছোটখাট কাজ করে থাকেন।
কিন্তু বাংলাদেশিরা কেন সেখানে কর্মসংস্থানের জন্য যাচ্ছেন এমন প্রশ্নের জবাবে ব্র্যাকের অভিবাসন বিভাগের প্রধান শরিফুল হাসান বেনারকে বলেন, সুদান একটি দরিদ্র দেশ। দেশটি বাংলাদেশের মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের স্থান নয়।
তিনি বলেন, “পৃথিবীর যে কয়টি দেশের নাগরিকরা অবৈধপথে মানবপাচারকারীদের মাধ্যমে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপীয় দেশগুলোতে যায়, তাদের মধ্যে বাংলাদেশিরা কয়েক বছর ধরে প্রথম সারির দিকে।”
শরিফুল হাসান বলেন, “আমরা গবেষণা করে দেখেছি, মোট ১৮টি অবৈধপথে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়া যায়। এই ১৮টি পথের একটি হলো সুদান। সুদানের পাশের দেশ লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি অথবা গ্রিসে প্রবেশ করে এসব মানুষ।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশিরা সুদান যায় মূলত অবৈধ পথে ইউরোপীয় দেশগুলোতে প্রবেশ করতে। অন্য কোনো কারণে নয়।”
যাঁরা যেতে পারেন না তাঁরাই সেখানে অবস্থান করেন এবং পরে সুযোগ বুঝে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করেন।
গত সপ্তাহে সুদানের সামরিক বাহিনী ও আধা সামরিক বাহিনী আরএসএফের মধ্যে লড়াই শুরু হয়। এই সংঘাতে এক পক্ষের নেতৃত্বে আছেন সেনাপ্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান। অপর পক্ষে নেতৃত্ব দিচ্ছেন আরএসএফের প্রধান জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালো ওরফে হেমেদতি। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ওই সংঘাতে কয়েকশ মানুষ নিহত হয়েছেন।