নির্বাচনের আগে বড়ো পরিসরে শুরু হচ্ছে অনলাইন ও ইলেকট্রনিক যন্ত্রে আড়িপাতা
2023.10.20
ঢাকা
সংসদ নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে, কোনো ব্যক্তি নির্দিষ্ট কোন জায়গায় অবস্থান করছেন তা চিহ্নিত করার পাশাপাশি, ওই ব্যক্তির হোয়াটস অ্যাপ কথোপকথন, ফটো ও ভিডিও গ্যালারিসহ অনলাইনে সব কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করার মতো প্রযুক্তি চালু করতে যাচ্ছে সরকার।
মানবাধিকার কর্মীদের মতে, সব ধরনের ইলেকট্রনিক যন্ত্রে আড়িপাতার এই ব্যবস্থা নাগরিকদের গোপনীয়তা বিষয়ে সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করবে।
নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধীদলকে ‘নির্মূল ও হয়রানি’ করতেই সরকার এ ধরনের নতুন ব্যবস্থা চালু করছে বলে মন্তব্য করেছে বিএনপি।
যদিও অনলাইন কার্যক্রম মনিটরিংয়ের জন্য এই লফুল ইন্টারসেপশন বা বৈধ আড়িপাতা ব্যবস্থা ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা’ ও অপরাধীদের ধরার জন্যই করা হচ্ছে বলে শুক্রবার বেনারের কাছে দাবি করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।
দেশের স্বার্থেই আড়িপাতা: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
“দেশের স্বার্থেই” লফুল ইন্টারসেপশন করতে হবে জানিয়ে শুক্রবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেন, “এটি ছাড়া অপরাধীদের ধরা যাবে না।”
তিনি বলেন, “ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অপরাধের ধরন পরিবর্তিত হয়ে গেছে। এখন অপরাধীরা অনলাইন মাধ্যম এবং মোবাইল ডিভাইস ব্যবহার করে অপরাধ করে থাকে। এদের ধরতে এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করতে লফুল ইন্টারসেপশন দরকার আছে।”
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এই কার্যক্রম শুরু করা হচ্ছে—বিরোধী দলের এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি। তাঁর মতে এই ব্যবস্থা ব্যক্তিগত গোপানীয়তা সংক্রান্ত সাংবিধানিক বিধানের সঙ্গেও “সাংঘর্ষিক নয়।”
“বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আড়িপাতা আইন আছে। তারাও লফুল ইন্টারসেপশন করছে, আমাদেরও করতে হবে। এই বিধান সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়,” বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
প্রসঙ্গত, আগামী বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা রয়েছে।
‘আড়াই কিলোমিটার দূর থেকে জনসমাগম মনিটর করা যাবে’
মানুষ টেলিফোন ও মোবাইল ফোনে কী কথা বলছেন সেটি গোপনে শুনতে ও রেকর্ড করতে ২০০৬ সালে টেলিকমিউনিকেশন আইন সংশোধন করে বৈধভাবে আড়িপাতার ব্যবস্থা চালু করে বিএনপি সরকার।
সে সময় আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও অধিকার কর্মীরা এই ব্যবস্থা প্রবর্তনে বিএনপির সমালোচনা করেছিল। এর পরে কোনো সরকারই এটি বন্ধে উদ্যোগ নেয়নি। বরং এর কলেবর বেড়েছে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তিদের কথোপকথন ফাঁস হওয়ার ঘটনা অব্যাহত রয়েছে।
বাংলাদেশে “আড়িপাতা বৈধ” বলে শুক্রবার বেনারকে জানান সাইবার নিরাপত্তা ও সাইবার প্রযুক্তি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের “আইন অনুযায়ী, একজন ব্যক্তির কথোপকথন ও কল লিস্ট দেখতে পারে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।”
বর্তমানে বিদ্যমান প্রযুক্তিতে কোনো ব্যক্তি কোন এলাকায় অবস্থান করছেন সেটা চিহ্নিত করা গেলেও সুনির্দিষ্টভাবে কোন স্থানে আছেন সেটি চিহ্নিত করা যায় না জানিয়ে তিনি বলেন, “লফুল ইন্টারসেপশন প্রবর্তনের মাধ্যমে ব্যক্তির সুনির্দিষ্ট অবস্থান চিহ্নিত করা সম্ভব।”
এই প্রযুক্তির মাধ্যমে “নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির কল রেকর্ড, কল লিস্ট দেখার পাশাপাশি তাঁর সব ধরনের অনলাইন কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে পারবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। হোয়াটস অ্যাপ থেকে শুরু করে ফটো গ্যালারি, ভিডিও গ্যালারি, টেক্সটসহ সব কিছু পর্যবেক্ষণ করা যাবে,” বলেন তিনি।
“এই প্রযুক্তির মাধ্যমে আড়াই কিলোমিটার দূর থেকে কোনো জনসমাগমের কার্যক্রম মনিটর করা যাবে,” যোগ করেন জোহা।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) ছাড়াও র্যাব এবং সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো অনলাইনে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করে থাকে।
এসব সংস্থা টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের সঙ্গে কাজ করে।
‘উদ্দেশ্য বিরোধীদের নির্মূল ও হয়রানি’
প্রধান রাজনৈতিক বিরোধী দল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শুক্রবার বেনারকে বলেন, নতুন লফুল ইন্টারসেপশনের মাধ্যমে নির্বাচনের আগে বিরোধী দল ও জোটগুলোকে “নির্মূল ও হয়রানি” করতেই এই পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার।
তিনি বলেন, “এই উদ্দেশ্যে তারা সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করেছে। আমরা সব সময়ই এই ধরনের নিবর্তনমূলক আইনের বিরোধী। আমরা এ ধরনের ব্যবস্থার তীব্র নিন্দা করি।”
সরকার এইভাবে “দেশের মানুষের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না,” বলেও মন্তব্য করেন মির্জা ফখরুল।
‘সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করা হবে’
বাংলাদেশের সংবিধানে “প্রতিটি নাগরিকের গোপনীয়তার নিশ্চয়তা দেওয়া আছে,” বলে শুক্রবার বেনারকে জানান মানবাধিকারকর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন।
তাঁর মতে, এ ধরনের ইন্টারসেপশনের মাধ্যমে “নাগরিকদের সেই সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করা হবে। লফুল ইন্টারসেপশনের কথা বলে সংবিধান লঙ্ঘন করে অপরাধ করছে রাষ্ট্র।”
এই ইন্টারসেপশনের মাধ্যমে “বিরোধী দলের রাজনৈতিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে, তাদের নেতা-কর্মীদের আটক করা হতে পারে,” বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
“এছাড়া, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অন্য ব্যক্তির প্রতি তাদের ব্যক্তিগত আক্রোশ ও স্বার্থ চরিতার্থ করতে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করবে, যা হবে মানবাধিকার লঙ্ঘন,” বলেন নূর খান।
পাশাপাশি, এই আড়িপাতা কার্যক্রমকে সহায়তা করতে মোবাইল কোম্পানি ও ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাড়তি খরচ করতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, “কোম্পানিগুলো তাদের ওই খরচের দায় গ্রাহকদের ওপর চাপিয়ে দেবে, যা অন্যায়।”