মজুরি বৃদ্ধির দাবি: পাতা তোলা বন্ধ রেখেছেন চা শ্রমিকেরা
2022.08.19
ঢাকা
চা বাগানের ভেতর বাড়ি মেরামত করার প্রয়োজনীয় মাটি সংগ্রহ করতে গিয়ে লাশ হলেন চার নারী শ্রমিক, যাদের মধ্যে তিনজন একই পরিবারের সদস্য। চা শ্রমিকদের টানা ১১ দিন আন্দোলন চলার মধ্যে পাহাড় ধসে এই মৃত্যু তাঁদের ক্ষোভ উসকে দিয়েছে।
শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার লাখাইছড়া চা বাগানে এই দুর্ঘটনা ঘটে।
পুলিশ জানায়, নিহতরা হলেন; হীরা রাণী ভৌমিক (৩৪), রিনা ভৌমিক (২০), পূর্ণিমা পুনি (২৩) এবং রাধা মণি মাহালী (৩৪)।
দৈনিক মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে ৯ আগস্ট থেকে চলমান কর্মবিরতির মধ্যেই চার চা শ্রমিকের মৃত্যু হলো। চা শ্রমিকরা দৈনিক ১২০ টাকার পরিবর্তে ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে কর্মবিরতি করে আসছেন।
তবে মালিকদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, শ্রমিকদের দাবি অযৌক্তিক। তাঁদের মতে, এই আন্দোলন বাংলাদেশের চা শিল্পকে ধ্বংস করার অংশ।
বাংলাদেশের ৯৭ হাজার চা শ্রমিক মূলত বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন চা বাগানের ভেতরে বসবাস করে থাকেন। তাঁদের বিনা ভাড়ায় কাঁচা ঘরে থাকতে দেয়া হয়। চা বাগান মালিকেরা টিন, কাঠ, দরজা, জানালা সরবরাহ করেন। তবে বাড়ির মূল কাঠামো নিজেদেরই বানাতে হয়। বর্ষা মৌসুমে সেগুলো মেরামত করার প্রয়োজন হয়।
মৌলভীবাজার জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাকারিয়া শুক্রবার বেনারকে বলেন, ওই চার চা শ্রমিক তাঁদের বাড়ি মেরামত করার জন্য মাটি সংগ্রহ করতে পাহাড়ে গিয়েছিলেন। মাটি সংগ্রহ করার সময় হঠাৎ পাহাড় ধসে তাঁদের ওপর পড়ে। মাটির নিচে চাপা পড়ে তাঁরা নিহত হন।
তিনি বলেন, “যেহেতু তাঁদের মৃত্যু নিয়ে কোনো প্রকার বিরোধ অথবা সন্দেহ নেই, সেহেতু আমরা রাতে তাঁদের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছি।”
এই ঘটনায় একটি অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা দায়ের করা হবে বলে জানান তিনি।
ঘটনাটিকে খুব মর্মান্তিক হিসাবে বর্ণনা করে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের উপদেষ্টা তপন দত্ত শুক্রবার বেনারকে বলেন, “বর্তমানে মালিকরা যে বাসস্থানের ব্যবস্থা করেন সেগুলো খুব ভালো নয় এবং মাটির তৈরি। এগুলো প্রতিবছর মেরামত করতে হয়। বাসা মেরামতের জন্য মাটি নিতে যাওয়ায় তাঁদের প্রাণ দিতে হয়েছে।”
তিনি বলেন, ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ চা সংসদ এবং বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের মধ্যে মজুরি ও সুবিধা সম্পর্কিত চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়।
প্রতি দুই বছর পর পর এই চুক্তি নবায়ন করা হয়।
২০২১ সালের জানুয়ারি মাস থেকে নতুন চুক্তি হওয়ার কথা থাকলেও মালিকরা নতুন চুক্তি করেননি বলে জানান তপন দত্ত।
চা শ্রমিকরা বলছেন, নতুন চুক্তির সময় তাঁরা তাঁদের মজুরি বাড়িয়ে নেন। তবে ২০১৮ সালের পর থেকে নতুন করে চুক্তি না হওয়ায় তাঁরা হতাশ এবং বাধ্য হয়েই রাস্তায় নেমেছেন।
মজুরিতে চলে না
শ্রীমঙ্গলের ফিনলে কোম্পানির চা শ্রমিক নূপুর কাহার শুক্রবার বেনারকে বলেন, “আমরা প্রতিদিন ২৪ কেজি পাতা তুললে ১২০ টাকা মজুরি পাই। এর বেশি তুললে প্রতি কেজি পাতার জন্য সাড়ে চার টাকা হিসাবে বোনাস পাই। বর্ষার সময় একজন শ্রমিক দিনে ৫০ কেজি পর্যন্ত পাতা তুলতে পারে। কিন্তু শীতের সময় পাতা কমে গেলে মজুরিও কমে যায়।”
তিনি বলেন, “আমরা সকালে চার থেকে পাঁচটি রুটি চা দিয়ে খেয়ে কাজে যাই। দুপুরে এবং রাতে আলু ভর্তা, অথবা চা পাতা ভর্তা দিয়ে ভাত খাই। প্রতি কেজি দুই টাকা দরে প্রতি সপ্তাহে চারজনের পরিবারের জন্য সাড়ে পাঁচ কেজি আটা কোম্পানি থেকে দেয়া হয়। কিন্তু চাল দেয়া হয় না।”
নূপুর কাহার বলেন, “আমার পরিবারে প্রতিদিন দুপুর ও রাতের জন্য দুই কেজি চাল লাগে। এগুলো বাইরে থেকে কিনে আনি। আপনি বলুন ১২০ টাকায় কীভাবে চলব? আমরা মাছ-মাংস খেতে পারি না।”
তিনি বলেন, “বর্তমানে আমরা কর্মবিরতিতে আছি। এখন কাজ নেই, বেতনও নাই। কীভাবে চলব? খুব কষ্টে আছি। প্রতিদিন ৩০০ টাকা মজুরি হলে চলতে পারব।”
তবে বাগান মালিকেরা বলছেন, শ্রমিকদের ৩০০ টাকা মজুরির দাবি গ্রহণযোগ্য নয়।
বাংলাদেশ চা সংসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং শ্রমিকদের সাথে আলোচনায় মালিকপক্ষের প্রতিনিধি তাহসিন আহমেদ শুক্রবার বেনারকে বলেন, “আমাদের সম্পর্কে যে কথা বলা হচ্ছে সেটি সঠিক নয়। কোভিড মহামারির কারণে চা শ্রমিকদের সাথে নতুন চুক্তি করা হয়নি।”
তিনি বলেন, “চার সদস্যের একটি চা শ্রমিক পরিবারের জন্য প্রতি মাসে ৪২ কেজি আটা দেওয়া হয়। তারা প্রতি কেজি আটা দুই টাকা করে কিনে নেয়।”
তাহসিন আহমেদ বলেন, “তাদের জন্য কোম্পানি বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। ওষুধ দেয়া হয়। প্রতি কেজি তোলা পাতার জন্য পাঁচ টাকা করে বোনাস দেয়া হয়। আমরা মালিকরা তাদের বাচ্চাদের জন্য স্কুলের পোশাক, খেলাধুলার বলসহ বিভিন্ন সামগ্রী দিয়ে থাকি।”
তিনি বলেন, “পুরুষ চা শ্রমিকরা তিন থেকে চার ঘণ্টায় তাদের কাজ শেষ করে বাগানের বাইরে গিয়ে বিভিন্ন কাজ করে, রিকশা চালায়। এভাবে তারা বাড়তি আয় করে। আপনি দেখাতে পারবেন না যে, তাদের কেউ না খেয়ে মারা গেছে।”
তাহসিন আহমেদ বলেন, “এগুলো প্রকৃতপক্ষে একটি ষড়যন্ত্রের অংশ। আমাদের পাট গেছে, চামড়া গেছে। এখন চা ধ্বংসের পথে। তবে আমরা শ্রমিকদের অধিকারের বিষয়ে সচেতন। আশা করি আগামী কয়েকদিনের মধ্যে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। শ্রমিকরা মালিক ছাড়া চলতে পারবে না। আবার আমরাও তাদের ছাড়া চলতে পারব না।”
তিনি বলেন, চা পাতা সময়মতো তুলতে হয়। সেটি দেরিতে তুললে কাজে আসে না। তাই এই আন্দোলন দ্রুত শেষ হওয়া দরকার।
বেসরকারি সংগঠন সেড প্রকাশিত চা শ্রমিকের কথা বই অনুযায়ী, চা উৎপাদনে চীনের আধিপত্য খর্ব করতে ১৮৩৯ সালে বৃহত্তর সিলেটের লাগোয়া ভারতের আসামে চা চাষ শুরু করে ব্রিটিশ সরকার।
বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালিনীছড়ায় প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হয়।
চা পাতা তোলার কাজ করাতে ভারতের বিহার, মাদ্রাজ, উড়িষ্যা, অন্ধ্রপ্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, উত্তর প্রদেশ থেকে নিম্নবর্ণের হিন্দু, দলিত ও আদিবাসীদের সিলেট অঞ্চলের চা বাগানে আনা হয়।
তাদের স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে মিশতে দেয়া হয় না। চা শ্রমিকরা বাগানের ভেতরেই অবস্থান করেন। তাঁদের সন্তান-সন্ততিরাও প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে চা বাগানে কাজ করে যাচ্ছেন। খুব কমই চা শ্রমিক তাদের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া শেখাতে পারেন।