পতেঙ্গা টার্মিনাল ২২ বছর পরিচালনা করবে সৌদি প্রতিষ্ঠান
2023.12.06
ঢাকা
দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বন্দরের একটি কন্টেইনার টার্মিনাল ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশি কোম্পানিকে দিয়েছে সরকার।
বুধবার চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরের নবনির্মিত পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার জন্য সৌদি মালিকানাধীন রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনালকে ২২ বছরের জন্য (আরএসজিটিআই) এই কাজ দেয়া হয় বলে বেনারকে জানান চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সফররত সৌদি বিনিয়োগ মন্ত্রী খালিদ আল ফালিহের উপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল ও আরএসজিটিআই‘র প্রধান নির্বাহী জাঁ ও. ফোলি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
সরকারের মতে, সৌদি কোম্পানিকে কন্টেইনার টার্মিনাল ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা করতে দেয়ার ফলে বন্দরের কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা বাড়বে এবং আঞ্চলিক যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে।
“বন্দরের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো বিদেশি কোনো কোম্পানিকে চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল পরিচালনার জন্য কাজ দেয়া হয়েছে,” বেনারকে বলেন সচিব ওমর ফারুক।
এই টার্মিনালে বছরে পাঁচ লাখ টোয়েন্টি-ফুট ইক্যুয়েভেলেন্ট ইউনিটস (টিউজ) পর্যন্ত কন্টেইনার ওঠানামা করবে জানিয়ে তিনি বলেন, এর ফলে “চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর কন্টেইনারের চাপ কমে আসবে এবং কাজে গতিশীলতা বাড়বে।”
এই টার্মিনালটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০০৭ সালে, নির্মাণে খরচ হয় এক হাজার ২২৯ কোটি টাকা। টার্মিনালটিতে সৌদি কোম্পানি প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনা ছাড়াও ১৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে বলে জানান সচিব।
রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যম বাসস জানায়, চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা এমন একটি ভবিষ্যতের অপেক্ষায় আছি যেখানে পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধির চালিকাশক্তি হয়ে উঠবে। এটি ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করবে।”
বেনারের হাতে আসা সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদনের জন্য প্রস্তুতকৃত নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের কার্যপত্র অনুযায়ী আরএসজিটিআই এক টিউস কন্টেইনার পণ্য ওঠানামার জন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে ১৮ ডলার পরিশোধ করবে।
এক বছরে পাঁচ লাখ টিউজের বেশি কন্টেইনার ওঠানামা করলে বাড়তি আয়ের শতকরা ৭০ ভাগ নেবে সৌদি কোম্পানি এবং ৩০ ভাগ পাবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।
বন্দরের কাজে গতিশীলতা বাড়বে
চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকর্তারা জানান, বন্দরের চট্টগ্রাম কন্টেইনার টার্মিনাল (সিসিটি) এবং নিউ মুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনার জন্য অপারেটর ও বার্থ অপারেটর হিসাবে কাজ করে বাংলাদেশি কোম্পানি সাইফ পাওয়ারটেক।
তবে তাদের সাথে শতকরা হারে আয় ভাগাভাগি করে না চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।
প্রতি বছর অপারেটর নিয়োগের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়। সেই দরপত্র অনুযায়ী যে কোম্পানি সবচেয়ে কম টাকায় টার্মিনাল অপারেটর হিসাবে কাজ করতে চায় তাকেই নিয়োগ করা হয়। কয়েক মাস পর পর তাদের দেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বুধবার বেনারকে বলেন, “সৌদি আরবের একটি কোম্পানিকে টার্মিনাল অপারেট করতে দেয়া হয়েছে সেটি খারাপ কিছু নয়। এই খাতে বিদেশি বিনিয়োগ হবে সেটি আমাদের জন্য ভালো।”
“তবে, সমস্যা হচ্ছে সৌদি আরবের নিজস্ব কোনো পেশাদার লোক নেই। তারা অন্যান্য দেশ থেকে লোক ভাড়া করে নিয়ে আসবে। টার্মিনালটি চালাবে অন্য দেশের লোকেরা। সুতরাং, এটি সৌদি আরবের হাতে থাকবে না,” যোগ করেন তিনি।
অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, “এই টার্মিনালের আয়ের সিংহভাগ যদি কোম্পানির কাছে যায়, তাহলে প্রশ্ন তোলা যায়, এখানে বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষিত হচ্ছে কি না।”
তিনি বলেন, “আমাদের দেখতে হবে, দেশীয় অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেক অন্যান্য টার্মিনাল পরিচালনা করে কোন কোন শর্তে। দুই অপারেটরের শর্তের মধ্যে পার্থক্য থাকলে দিন শেষে চট্টগ্রাম বন্দর ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।”
নৌপরিবহন অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক কমডোর সৈয়দ আরিফুল ইসলাম বুধবার বেনারকে বলেন, “প্রথমবারের মতো একটি বিদেশি কোম্পানি বাংলাদেশের বন্দরে বিনিয়োগ করল। এর ফলে আশা করা যায় বন্দরের কাজে গতিশীলতা বাড়বে। অর্থাৎ স্বল্প সময়ের মধ্যেই বন্দরে কন্টেইনার ওঠা-নামা করানো যাবে। বন্দর চত্বরে কন্টেইনার জট থাকবে না।”
চট্টগ্রাম বন্দরের মোট চারটি টার্মিনালের মধ্যে তিনটি একটি দেশীয় কোম্পানি এবং চতুর্থটি সৌদি কোম্পানি পরিচালনা করলে দেশি-বিদেশি অপারেটরের সাথে প্রতিযোগিতা থাকবে এবং সার্বিকভাবে সেবার মান উন্নত হবে বলে মনে করেন তিনি।
“চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। কারণ ভারতের বিশাল ভূখণ্ড বেষ্টিত উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় আট রাজ্য, নেপাল ও ভুটানের জন্য চট্টগ্রাম অর্থনৈতিকভাবে ও যোগাযোগের দিক থেকে সবচেয়ে ভালো বন্দর। ভারতের সাথে ট্রানজিট পুরোপুরি শুরু হলে ভবিষ্যতে চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম অনেক বৃদ্ধি পাবে,” বলেন আরিফুল ইসলাম।
তাঁর মতে, “চট্টগ্রাম বন্দরের গতিশীলতা বাড়াতে টার্মিনালের ট্যারিফ হার নির্ধারণের ক্ষমতা অবশ্যই চট্টগ্রাম বন্দরের হাতে থাকতে হবে এবং সকল টার্মিনালের ট্যারিফ হার সমান হতে হবে।”
তিনি বলেন, “যদি অন্যান্য টার্মিনালের চেয়ে পতেঙ্গা টার্মিনালে খরচ কম হয় সেক্ষেত্রে জাহাজগুলো পতেঙ্গা টার্মিনালে যাবে এবং অন্যান্য টার্মিনাল ফাঁকা থেকে যাবে। এতে চট্টগ্রাম বন্দর আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং বন্দরের আয় কমে যাবে।”
বাংলাদেশের মোট তিনটি চালু বন্দর রয়েছে: চট্টগ্রাম, মংলা ও পায়রা। এই তিনটির মধ্যে চট্টগ্রাম বাংলাদেশের শতকরা ৯২ ভাগ কন্টেইনার ওঠানামা করে। ফলে এই বন্দরে দেশীয় আমদানি-রফতানি পণ্য খালাসে অনেক সময় জট সৃষ্টি হয় এবং বাড়তি সময়ের জন্য ব্যবসায়ীদের বাড়তি টাকা খরচ দিতে হয় বন্দর কর্তৃপক্ষকে।