তিউনিসিয়ায় নিহত ৮ বাংলাদেশির পরিচয় প্রকাশ, জীবিত উদ্ধার ৭ জনের পাসপোর্ট নেই
2024.02.20
ঢাকা
ইতালি যেতে পৈত্রিক জমি বিক্রির ১৪ লাখ টাকা দালালকে দিয়েছিলেন মামুন সেখ। জমি তো গেছেই, মামুনও আর বেঁচে নেই। “এখন আমাদের একটাই চাওয়া, ওর লাশ আমরা যেন পাই,” মঙ্গলবার বেনারকে বলেন মামুনের বড়ো ভাই সজীব সেখ।
গত ১৪ ফেব্রুয়ারি তিউনিসিয়া উপকূলে পৌঁছালে ইউরোপযাত্রাী অবৈধ অভিবাসীদের নৌকা আগুন লেগে ডুবে গিয়ে আট বাংলাদেশিসহ মোট নয় জন মারা যান, তাঁদের মধ্যে মামুন সেখ একজন। মঙ্গলবার নিহত বাংলাদেশিদের পরিচয় প্রকাশ করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
“আমার ভাই মামুন শেখ বেশি দূর লেখাপড়া করেনি। দালালের প্রলোভনে সে ইতালি যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিল। আমি, মা-বাবা কেউ রাজি ছিলাম না। শেষমেশ ওর জেদের কারণে আমরা রাজি হয়েছিলাম,” বলেন সজীব।
তিনি জানান, “স্থানীয় দালাল মোশারফ ও তাঁর বাবার সঙ্গে আগাম এক লাখ টাকা এবং লিবিয়া পৌঁছানোর পরে আরও ১৩ লাখ টাকা দেয়ার মৌখিক চুক্তি হয়েছিল। কথা মতো, আমরা বাকি ১৩ লাখ টাকা পরিশোধও করেছি।”
সজীব জানান, গত ১৫ জানুয়ারি ঢাকা ছাড়েন মামুন। তাঁকে দুবাইয়ে দুই দিন রাখার পর প্রথমে মিশর, পরে অন্যদের সাথে লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় রাজধানী বেনগাজিতে নেওয়া হয়।
দুর্ঘটনার পর জীবিত উদ্ধার হওয়া তাঁর ভাইয়ের কয়েক সঙ্গীর সঙ্গে সজীব কথা বলেছেন। তাঁদের বরাত দিয়ে তিনি বেনারকে বলেন, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিতে প্রবেশ করতে বেনগাজি থেকে তাদের নেওয়া হয় রাজধানী ত্রিপলিতে। সেখান থেকে তাঁদের নৌকায় তুলে দেওয়া হয়।
ত্রিপলি পৌঁছানোর পরেও মামুনের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে জানিয়ে সজীব বলেন, “লিবিয়া গিয়ে আমার ভাই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। খাওয়া-গোসল কোনো কিছুরই ঠিক ছিল না।”
সজীব জানান, নৌকায় ৩০ জনের ধারণ ক্ষমতা ছিল, অথচ তোলা হয়েছিল ৫২ জন। মামুনসহ ১২ জনকে নৌকার পাটাতনের নিচে যেখানে জ্বালানি রাখা হয়, সেখানে বসতে দেওয়া হয়েছিল। ওখানেই ওরা মারা গেছে।
“সারা জীবন আমাদের এই কষ্ট নিয়ে বাঁচতে হবে,” যোগ করেন সজীব।
সাত বাংলাদেশির পাসপোর্ট নেই
তিনটি দেশ ভ্রমণ করে সাগর পথে নৌকায় ইউরোপের উদ্দেশে রওনা হলেও জীবিত উদ্ধার ২৭ বাংলাদেশি নাগরিকের মধ্যে সাত জনের কাছে পাসপোর্ট পাওয়া যায়নি।
লিবিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল আবুল হাসনাত মুহাম্মদ খায়রুল বাশারের সঙ্গে মঙ্গলবার বেনারের কথা হয়।
পাসপোর্ট ছাড়া সাত জন কীভাবে লিবিয়া পর্যন্ত গেলেন—জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমার মনে হয়, দুবাই পর্যন্ত তারা পাসপোর্ট নিয়ে এসেছে। অনেক সময় দালালরা পাসপোর্ট কেড়ে নেয়।”
“দালালরা সারা বিশ্ব থেকে মানুষ জড়ো করে মিশর থেকে ‘বিশেষ বিমান’ ভাড়া করে লিবিয়া নিয়ে আসে,” বলেন তিনি।
নিহত বাংলাদেশিদের মরদেহ দেশে ফিরিয়ে নিতে কিছুটা সময় লাগবে জানিয়ে তিনি বলেন, তবে কতদিন সময় লাগবে তা বলা যাচ্ছে না।
“তিউনিসিয়ার কর্তৃপক্ষ মরদেহগুলোর ময়নাতদন্ত করবে। এছাড়া, মরদেহ দেশে নেওয়ার খরচ আছে। আমরা প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে খরচের বিষয়টি অবহিত করে চিঠি লিখেছি। আইনি প্রক্রিয়া শেষ হলে এবং অর্থ পাওয়া গেলেই মরদেহগুলো দেশে ফেরত পাঠানো হবে,” বলেন বাশার।
নিহতরা মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জের বাসিন্দা
জীবিত উদ্ধার বাংলাদেশিদের প্রত্যাবাসন ও নিহতদের পরিচয় শনাক্তে সোমবার লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব (শ্রম) মো. রাসেল মিয়ার নেতৃত্বে একটি দল তিউনিসিয়ায় যায়।
তাঁদের তথ্য অনুসারে, নিহত আট জনের মধ্যে পাঁচ জন মাদারীপুর ও তিন জন গোপালগঞ্জের বাসিন্দা।
তাঁরা হলেন—মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার শেনদিয়া এলাকার বাসিন্দা সজল, একই উপজেলার কদমবাড়ি উত্তরপাড়ার পরিতোষ বিশ্বাসের ছেলে নয়ন বিশ্বাস, সরমঙ্গল এলাকার মামুন সেখ, তেলিকান্দি এলাকার কাজী মিজানুরের ছেলে কাজী সজীব, কেশরদিয়ার কায়সার এবং গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার বড়দিয়া এলাকার বাসিন্দা দাদনের ছেলে রিফাত, একই উপজেলার ফতেহপট্টির রাসেল ও গয়লাকান্দি এলাকার মো. পান্নু শেখের ছেলে ইমরুল কায়েস আপন।
এছাড়া, জীবিত উদ্ধার মাদারীপুরের রাজৈর থানার আমগ্রাম ইউনিয়নের মনোরঞ্জন সরকারের ছেলে মনতোষ সরকারের শারীরিক অবস্থা আশঙ্কাজনক। তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
প্রয়োজন পরিবারের সচেতনতা
ব্র্যাকের অভিবাসন শাখার প্রধান শরিফুল হাসান মনে করেন, অপ্রত্যাশিত মৃত্যু রোধে পরিবারগুলোর সচেতনতা প্রয়োজন।
তিনি মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “পরিবার সচেতন না হলে এভাবে অবৈধ পথে বিদেশ যাওয়া বন্ধ করা যাবে না। মানব পাচারকারীদের নেটওয়ার্ক অত্যন্ত শক্ত এবং এর পেছনে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যবসা রয়েছে।”
উল্লেখ্য, উন্নত জীবনের আশায় দালালের মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্বের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছিলেন তিউনিসিয়ায় দুর্ঘটনার কবলে পড়া ৩৫ বাংলাদেশি। দুবাই, মিশর, লিবিয়া হয়ে নৌকায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে তাঁদের ইউরোপ যাওয়ার কথা ছিল।
গত ১৪ ফেব্রুয়ারি তিউনিসিয়া উপকূলে পৌঁছালে প্রথমে নৌকায় আগুন লেগে যায় এবং পরে ডুবে যায়। এতে নয় জন নিহত হন।
ওই ঘটনায় ৪৪ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়, এর মধ্যে ২৭ জন বাংলাদেশি। বাকিদের মধ্যে পাকিস্তানের আট জন, সিরিয়ার পাঁচ জন, মিশরের তিন জন। নৌকার মাঝিও মিশরের নাগরিক।