ভূমধ্যসাগরে ৮ বাংলাদেশির মৃত্যু, পাচারকারীর ছেলেসহ আটক দুই

কামরান রেজা চৌধুরী
2024.04.22
ঢাকা
ভূমধ্যসাগরে ৮ বাংলাদেশির মৃত্যু, পাচারকারীর ছেলেসহ আটক দুই মাদারীপুরের বদরপাশা ইউনিয়নের সাফায়েত মোল্লা ২০২২ সালে সমুদ্র পথে অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার পথে মারা যান। নিহত সাফায়েতের মা মোবাইল ফোনে ছেলের ছবি সাংবাদিকদের দেখাচ্ছেন। ১০ মার্চ ২০২৪।
[মো: হাসান/বেনারনিউজ]

প্রায় দুই মাস আগে অবৈধভাবে লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি প্রবেশকালে তিউনিশিয়ার জলসীমায় আট বাংলাদেশির প্রাণহানির ঘটনায় বাংলাদেশে দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব।

তাঁরা হলেন; লিবিয়া-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী বাংলাদেশ সিণ্ডিকেটের মূল নেতা মোশারফ কাজীর ছেলে যুবরাজ কাজী (২৪) ও আরেক নেতা রহিম শেখের ভাই কামাল শেখ (৩৮)। গোপালগঞ্জ জেলার মকসুদপুর থেকে তাঁদের আটক করা হয়।

পুলিশের বিমানবন্দর জোনের সহকারী কমিশনার আসমা আক্তার সোনিয়া সোমবার বেনারকে বলেন, “আটক দুই ব্যক্তিকে বিমানবন্দর থানায় হস্তান্তর করেছে র‌্যাব। তারা পুলিশের হেফাজতে আছে এবং তাদের আদালতে সোপর্দ করা হবে।”

সংঘবদ্ধভাবে খুনের ৩০২/৩৪ ধারা এবং মানবপাচার প্রতিরোধ আইনে গত ১৯ এপ্রিল মামলা দায়ের করার দুইদিন পরই তাঁদের আটক করা হয়।

মামলার প্রাথমিক তথ্য বিবরণী ও এজাহারের একটি কপি বেনারের হাতে এসেছে। বিমানবন্দর থানায় মামলাটি দায়ের করেন নিহত সজল বৈরাগীর পিতা সুনীল বৈরাগী।

ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, মোশারফ কাজী ও রহিম শেখ লিবিয়ায় অবস্থান করেন। সেখানে তাঁদের ঠিকানা রয়েছে, যেখানে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অভিবাসীদের আটকে রেখে মানবপাচারের কাজে ব্যবহার করা হয়।

তাঁদের আত্মীয়-স্বজনেরা স্থানীয়ভাবে মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ ও আশেপাশের অন্যান্য জেলায় লোকজনকে ইতালি পাঠানোর কথা বলে টাকা সংগ্রহ করে অবৈধপথে ইউরোপ পাঠান। এদের অনেকেই ভূমধ্যসাগরে প্রাণ হারান।

সর্বশেষ গত ১৪ ফেব্রুয়ারি তিউনিশিয়ার জলসীমায় ৩৪ বাংলাদেশিসহ ৫৩ অবৈধ অভিবাসী বহনকারী একটি ট্রলার ডুবে যায়। ওই ঘটনায় আট বাংলাদেশি নিহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান ২৬ বাংলাদেশি, যাঁদের অধিকাংশই মাদারীপুর জেলার অধিবাসী।

আট নিহত বাংলাদেশি হলেন; মামুন শেখ, সজল বৈরাগী, নয়ন বিশ্বাস, রিফাত শেখ, সজীব কাজী, ইমরুল কায়েস আপন, মো. কায়সার ও রাসেল শেখ।

মামলার অভিযোগ যা বলা হয়েছে

এজাহারে সুনীল বৈরাগী অভিযোগ করেন, তাঁর ছেলে সজল বৈরাগী উন্নত জীবনের আশায় ইতালি যেতে ইচ্ছুক ছিলেন।

সজলের পূর্ব পরিচিত যুবরাজ কাজী (২৪) এবং লিবিয়ায় অবস্থানরত মোশারফ কাজী ১৪ লাখ টাকার বিনিময়ে তাঁকে বৈধ পথে ইতালি প্রেরণের প্রস্তাব দেন। সজল বৈরাগী ও তাঁর পরিবার এই প্রস্তাবে রাজি হয়।

দুই পক্ষের সম্মতিতে গত বছর ১৭ নভেম্বর যুবরাজ কাজীর গোপালগঞ্জের বাসায় আড়াই লাখ টাকা এবং পাসপোর্ট দেন সজল। ৩০ ডিসেম্বর তাঁকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেয়া হয়।

বিমানবন্দরে প্রবেশের আগে গাড়ি থেকে নামার আগেই সজলের কাছ থেকে আরও নগদ পাঁচ লাখ টাকা নেন যুবরাজ কাজী। ৩১ ডিসেম্বর সকাল ছয়টায় দুবাই রওনা হন তিনি।

৮ জানুয়ারি গোপালগঞ্জের বাসায় গিয়ে যুবরাজ কাজীর হাতে আরও সাড়ে ছয় লাখ টাকা দিয়ে আসেন পিতা সুনীল বৈরাগী। কিন্তু এরপর থেকে ছেলের সাথে যোগাযোগ করতে পারেননি সুনীল।

এরপর গণমাধ্যমে তিনি জানতে পারেন, ১৪ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত সাড়ে ১১টা থেকে ভোর চারটার মধ্যে লিবিয়া থেকে ইতালি অভিমুখে যাত্রা করা একটি ট্রলারে যে আট বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন তার মধ্যে সজল রয়েছেন।

তিনি অভিযোগ করেন, যুবরাজ কাজী, মোশারফ কাজী, রহিম শেখ, কামাল শেখসহ আরও প্রায় ২০ জন পারস্পরিক যোগসাজশে নিহতদের উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে অবৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার করেন। তাঁরা নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও উত্তাল সাগরে ছোট নৌকায় তুলে দিয়ে পানিতে ডুবিয়ে তাদের মৃত্যু ঘটান।

ভুক্তভোগীর অভিজ্ঞতা

দুর্ঘটনায় পড়া ওই নৌকার আরোহী ছিলেন মাদারীপুরের বুলু শেখ (৪০)। সোমবার বেনারকে তিনি বলেন, “রাত নয়টার দিকে আমাদের লিবিয়া উপকূলে নিয়ে যাওয়া হয়। সবাইকে ছোট একটি নৌকায় উঠতে বলা হয়। আমরা উঠতে রাজি হইনি। কিন্তু পরে উঠতে বাধ্য হই।”

বুলু শেখ বলেন, “ওই নৌকায় সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ২০ জন উঠতে পারে। সেখানে ৩৪ বাংলাদেশিসহ ৫৩ জন মানুষ ছিলেন। এর মধ্যে আট পাকিস্তানি ও সুদানের দুই নাগরিক ছিলেন।”

তিনি বলেন, “সজলসহ যে আটজন মারা গেছে, তাদের বেঁধে নৌকার পাটাতনের নীচে একটি প্লাস্টিকের ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। ওই চেম্বারে ডিজেলের বড়ো বড়ো কন্টেইনার ছিল।”

বুলু শেখ বলেন, “ছয় থেকে সাত ঘণ্টা চলার পর নৌকা ডুবে যেতে থাকে। তখন আমরা যারা পাটাতনে বসেছিলাম, তাঁরা সবাই পানিতে ঝাঁপ দেই। নৌকার যে অংশ ভেসে ছিল সেটি ধরে ভাসতে থাকি। নৌকা থেকে ৩০টির বেশি ডিজেল কন্টেইনার ফেলে দিই যাতে আমরা ভাসতে পারি।”

তিনি বলেন, “তিউনিশিয়ার কোস্টগার্ড আমাদের উদ্ধার করে। এরপর আইওএম’র সহায়তায় বাংলাদেশে ফিরে আসি।”

ওই নৌকায় নিহত মামুন শেখের ভাই সজীব শেখ সোমবার বলেন, “র‌্যাব দুজনকে আটক করেছে। তারা আমাদের কাছ থেকেও ১৪ লাখ টাকা নিয়েছে।”

তিনি বলেন, “ওই ঘটনার পর তাদের কাছে টাকা ফেরত চেয়েছিলাম। কিন্তু তারা টাকা ফেরত দিতে অস্বীকার করে। বলেছে, টাকা খরচ হয়ে গেছে।”

সজীব শেখ বলেন, “তাদের কথা, থানায় ৫০ লাখ টাকা খরচ করব। কিন্তু তোদের এক টাকাও দেবো না, যা পারিস কর।”

কেন মাদারীপুর?

ওয়ারবি ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের প্রধান সৈয়দ সাইফুল হক বেনারকে বলেন, যেসব বাংলাদেশি ইতালি থাকেন, তাঁদের অধিকাংশই মাদারীপুর জেলার বাসিন্দা।

তিনি বলেন, “অবৈধ পথে ইতালি যাওয়া এই অঞ্চলের মানুষের একটি বিরাট প্রবণতা বলা যায়। তারা জানে প্রাণ যেতে পারে। তারপরও পরিস্থিতির পরিবর্তন হচ্ছে না।”

সাইফুল হক বলেন, “যারা অবৈধভাবে ইতালি যেতে পেরেছেন, তাঁদের দেখে অন্যরা উৎসাহিত হন এবং মানুষের এই অতি আগ্রহের সুযোগ নেয় মানবপাচারকারীরা।

এখনও আনা হয়নি লাশ

লিবিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এ.এইচ.এম. খায়রুল বাশার বেনারকে বলেন, আট বাংলাদেশির মরদেহ তিউনিশিয়ার মর্গে রাখা আছে।

তিনি বলেন, “আশা করছি এই মাসের শেষে অথবা আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে লাশগুলো বাংলাদেশে পৌঁছবে। লাশগুলো পাঠাতে সময় লাগার কারণ হলো, তিউনিশিয়ায় আমাদের কোনো আবাসিক দূতাবাস নেই। লিবিয়া থেকে গিয়ে কাজ করতে হয়।”

রাষ্ট্রদূত বলেন, “লিবিয়া-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক এই মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছে। এদের কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। আমরা লিবিয়া সরকারের সাথেও কাজ করছি। দেখা যাক কীভাবে এদের নেটওয়ার্ক ধ্বংস করা যায়।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।