মানবপাচার বিরোধী ভূমিকার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে ‘হিরো’ হিসেবে সম্মানিত বাংলাদেশি আল-আমিন
2024.06.24
ওয়াশিংটন ডিসি
মানবপাচার বিরোধী লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের আল-আমিন নয়নকে ‘হিরো’ হিসেবে সম্মানিত করেছে।
সোমবার ওয়াশিংটন ডিসিতে মার্কিন পররাষ্ট্রদপ্তর বার্ষিক ‘ট্রাফিকিং ইন পারসনস’ (টিআইপি) প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে নয়নের হাতে এই সম্মাননা তুলে দেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন।
নয়ন ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের মাইগ্রেশন ওয়েলফেয়ার সেন্টারের ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত। মানবপাচারের শিকার হওয়া হাজারো মানুষকে সহায়তা করার জন্য নয়নকে এই সম্মাননায় ভূষিত করা হয়েছে বলে জানানো হয় মার্কিন পররাষ্ট্রদপ্তরের বিবৃতিতে।
ঢাকার বিমানবন্দরে কোনো প্রবাসী কোনো সমস্যায় পড়লে সবার আগে নয়ন ছুটে যান বলে জানানো হয় অনুষ্ঠানে।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়াশোনা শেষে নয়ন নিজেও এককালে “বিদেশে উচ্চ বেতনের চাকরির’ লোভে মানবপাচারের শিকার হয়েছিলেন বলে অনুষ্ঠানের বক্তব্যে জানান মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “তাঁর পাসপোর্টসহ অন্যান্য খরচ জোগাতে নয়নের বাবা মা নিজেদের বেশিরভাগ জমিজমা বিক্রি করেন। কিন্তু তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় প্রতিবেশী একটি দেশে, এবং অন্যদের সাথে তাঁকে একটি গভীর বন কেটে পরিষ্কার করার কাজ করতে বাধ্য করা হয়।”
“তাঁদেরকে কখনো কোনো মজুরি দেয়া হয়নি। কারোই সেই স্থান ত্যাগের অনুমতি ছিল না,” বলেন ব্লিনকেন।
নয়নকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, “আমরা যদি ক্লান্ত হয়ে পড়তাম বা কাজ করতে রাজি না হতাম, তবে আমাদের মারধর করা হতো।”
ওই নিষ্ঠুর পরিস্থিতিতে সাত মাস থাকার পরে নয়নসহ কয়েকজন ঝুঁকি নিয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে দূতাবাসে পৌঁছে দেশে ফিরে আসেন বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, “কিন্তু সেটিই গল্পের শেষ নয়, পালিয়ে আসার পর নয়ন মানবপাচারের শিকার ব্যক্তিদের সহায়তা করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন।”
“কয়েক বছর পর, তাঁর উদ্যোগে হাজারো মানুষ নিজেদের স্বাধীনতা ফিরে পান,” যোগ করেন ব্লিনকেন।
নয়ন ২০০৭ সালে পাচারের শিকার হয়ে মালয়েশিয়াতে সাত মাস দুর্বিসহ অভিজ্ঞতার শিকার হন বলে বিবৃতিতে জানায় মার্কিন পররাষ্ট্রদপ্তর।
সোমবার প্রকাশিত মার্কিন প্রতিবেদনে বিশ্বের ১৮৮টি দেশের মানবপাচার পরিস্থিতির মূল্যায়ন করা হয়েছে। বর্তমানে বৈশ্বিকভাবে প্রায় দুই কোটি সত্তুর লাখ মানুষ মানবপাচারের শিকার বলে জানান অ্যান্টনি ব্লিনকেন।
তিনি বলেন, “বিশ্বের সবচে দুর্বলতম এবং ঝুঁকির মধ্যে থাকা মানুষরাই পাচারকারীদের শিকারে পরিণত হয়।”
‘নয়ন আমাদের সবার হিরো’
আল আমিন নয়নের মতো পাচারের শিকার ও প্রবাসীদের কল্যাণে নিবেদিত মানুষ “বিরল,” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান। তিনি বলেন, নয়ন তাঁর নিজের কাজের কারণে প্রবাসীদের ‘নয়ন ভাই’ হয়ে উঠেছেন।”
নয়ন তাঁর কাজের জন্য ২০২৩ সালে ব্র্যাকের সবচেয়ে সম্মানজনক ‘স্যার ফজলে হাসান আবেদ মূল্যবোধ অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন জানিয়ে শরিফুল হাসান বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের টিআইপি পুরস্কার তাঁকে নিজের কাজে নতুন শক্তি দেবে।”
“নয়ন আসলে আমাদের সবারই হিরো,” যোগ করেন শরিফুল হাসান।
এদিকে আল-আমিন নয়ন মানব পাচারের মিথ্যা মামলায় আটক হয়ে ২০২৩ সালে ৭ দিন কারাগারে ছিলেন বলে বেনারকে জানান তাঁর আইনজীবী অ্যাডভোকেট নোমান হোসাইন তালুকদার।
তিনি বলেন, "ভুক্তভোগীদের সহযোগিতা করায় ওই মামলা করেছিল মানব পাচারকারীরা। বর্তমানে তিনি মামলায় স্থায়ী জামিনে রয়েছেন।”
যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে ২০০১ সাল থেকে টিআইপি প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে দেশটি। ২০০৪ সাল থেকে মানবপাচার প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখার জন্য প্রতিবছর গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ‘হিরো’ হিসেবে সম্মানিত করা হচ্ছে।
গত বিশ বছরে বিশ্বের ৯০টির বেশি দেশের ১৭০ জনের বেশি ব্যক্তিকে এই সম্মাননা দেয়া হয়েছে বলে জানানো হয় প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত বিবৃতিতে।
চলতি বছর নয়ন ছাড়াও হিরো হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের আরো নয় জনকে মানবপাচার বিরোধী লড়াইয়ে হিরো হিসেবে সম্মানিত করে যুক্তরাষ্ট্র।
সোমবার প্রকাশিত মার্কিন প্রতিবেদনে বলা হয়, মানবপাচার নির্মূলের ব্যাপারে নূন্যতম মান রক্ষা না করলেও মানবপাচার বন্ধ করতে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছে। এর ফলে আগের মতো এ বছরও মার্কিন মূল্যায়নে দ্বিতীয় ধাপেই অবস্থান করছে বাংলাদেশ।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে অয়ন আমান।