ভৈরবে রেল দুর্ঘটনা, নিহত অন্তত ১৭
2023.10.23
ঢাকা
২০১৯ সালের পর সবচেয়ে বড়ো রেল দুর্ঘটনা দেখল বাংলাদেশ। সোমবার ঢাকা থেকে ৮৫ কিলোমিটার দূরে দেশের অন্যতম ব্যস্ত রেলওয়ে স্টেশন কিশোরগঞ্জের ভৈরব স্টেশনের কাছে মালবাহী ট্রেনের ধাক্কায় যাত্রীবাহী রেলের দু’টি বগি লাইনচ্যুত হয়।
এই দুর্ঘটনায় অন্তত ১৭ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছেন আরও ৫০ জনের বেশি।
দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেনের যাত্রী ডা. ইয়াশফিকুল হক মুনিম কিশোরগঞ্জ থেকে ঢাকায় ফিরছিলেন। তিনি বেনারকে দুর্ঘটনার বর্ণনা দেন।
মুনিম জানান, ভৈরব স্টেশনে তাঁর ট্রেনটি ইঞ্জিন পরিবর্তন করে বিকেল ৩টা ২৫ মিনিটের দিকে ছাড়ার পর একটু দূর এগুতেই মালবাহী ট্রেনটি তাঁর ট্রেনের পেছনের বগিতে আঘাত করে।
“১০ থেকে ১৫ সেকেন্ড সময় পেলে যাত্রীবাহী ট্রেনটি পার হয়ে যেতে পারত,” মন্তব্য করে কিশোরগঞ্জের জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের এই চিকিৎসক বলেন, “স্টেশনের সিগন্যালের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের দায়িত্বে অবহেলার কারণে এটা ঘটেছে।”
ট্রেনটির সামনের দিকের বগিতে থাকায় তিনি আহত হননি জানিয়ে মুনিম বলেন, “এর পর অন্য ব্যবস্থায় আমার ঢাকায় রওয়ানা দিয়েছি।”
ভৈরবের উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মোহাম্মদ সাদিকুর রহমান সবুজ সাংবাদিকদের বলেন, “ঢাকাগামী যাত্রীবাহী এগারসিন্দুর এক্সপ্রেসে মালবাহী রেল ধাক্কা দিলে এ দুর্ঘটনা ঘটে।”
দুর্ঘটনা কবলিত ট্রেনের যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভৈরব থেকে যাত্রীবাহী ট্রেনটি ঢাকার দিকে ছেড়ে আসার পরপরই মালবাহী ট্রেনের ধাক্কায় এর দু’টি বগি উল্টে গিয়ে এই দুর্ঘটনা ঘটে।
দুর্ঘটনার পর ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ ও নোয়াখালীর রেল যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। উদ্ধারকাজে যুক্ত রয়েছে স্থানীয় ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকর্মী ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক দল।
উদ্ধার কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত কিশোরগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের স্টেশন অফিসার আবুজর গিফারি বেনারকে বলেন, “১৭ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ১৫ জনের মরদেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। আহত হয়েছেন আরও ৫০ এর উপরে।”
সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত নিহতদের মরদেহ দুর্ঘটনাস্থলেই ছিল বলে জানান তিনি। এ ঘটনায় “অসতর্কতা” ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, “কে দায়ী তা এখনো বলার সময় আসেনি।”
এই ঘটনায় দু’টি আলাদা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের জ্যৈষ্ঠ তথ্য কর্মকর্তা সিরাজ উদ-দৌলা খান।
এর আগে ২০১৯ সালের ১২ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার মন্দবাগ রেলওয়ে স্টেশনে তূর্ণা নিশীথা ও উদয়ন এক্সপ্রেসের মুখোমুখি সংঘর্ষে ১৭ জন নিহত হয়েছিলেন।
চালকসহ ৩ জন বরখাস্ত, তদন্ত কমিটি
দুর্ঘটনার পর মালবাহী ট্রেনের চালক বা লোকোমাস্টার, সহকারী চালক ও গার্ডকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন রেলওয়ের ঢাকা বিভাগীয় ব্যবস্থাপক মো. সফিকুল ইসলাম।
এছাড়া ঢাকা ও চট্টগ্রাম দু’টি আলাদা বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে আগামী তিন দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
স্থানীয় ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলীয় মহাপরিচালক নাজমুল ইসলামকে উদ্ধৃত করে জানায়, “প্রাথমিকভাবে মালবাহী ট্রেনের চালক জাহাঙ্গীর হোসেন সিগন্যাল অমান্য করে যাত্রীবাহী ট্রেনের বগিতে আঘাত করায় দুর্ঘটনা ঘটে বলে জানতে পেরেছি।”
তিনি বলেন, “ঘটনার পর থেকে চালক, সহকারী চালক ও গার্ড–তিন জন পলাতক।”
এক বছরে ট্রেন দুর্ঘটনা বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ
দেশে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে জনসচেতনতামূলক কাজ করে বেসরকারি সংগঠন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। তাদের তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালে রেল দুর্ঘটনায় মৃত্যু বেড়েছে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৯ শতাংশ। সমিতির তথ্য অনুযায়ী, গত বছর দেশের বিভিন্ন স্থানে ছোট-বড় ৬৬০টি রেল দুর্ঘটনায় ৫৫০ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন দুই শতাধিক। এর আগের বছর ৪০২টি দুর্ঘটনায় ৩৯৬ জন মারা গেছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেকেলে সিগন্যালিং ব্যবস্থা, দক্ষ চালকসহ জনবলের অভাব দেশে রেল দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।
“দক্ষ জনবলের অভাব আর সিগন্যালে ত্রুটির কারণেই বেশির ভাগ রেল দুর্ঘটনা ঘটে,” সোমবার বেনারকে বলেন যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী।
“এছাড়া রেলের ইঞ্জিন ও কোচ মেরামত না করা, মেয়াদোত্তীর্ণ কোচ, প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব এর পেছনে অন্যতম কারণ,” যোগ করেন তিনি।
এদিকে ভৈরবে ট্রেন দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।