একদিকে যুদ্ধের প্রভাব, অন্য দিকে রোজা: বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম
2022.03.14
ঢাকা
ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের অজুহাতে এবং আগামী মাসে শুরু হতে যাওয়া রোজাকে সামনে রেখে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়া শুরু হয়েছে। রোজার মাসে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পেঁয়াজ, ভোজ্য তেল ও আটা-ময়দার দাম ইতোমধ্যে কমপক্ষে ৫০ ভাগ বেড়ে গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের প্রকৃত নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আগেই বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়িয়েছেন।
তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে গম রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভারত থেকে বেশি দামে গম রপ্তানি করতে হচ্ছে এবং আটা-ময়দার দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।
“একটা যুদ্ধ পরিস্থিতি হলে আমাদের বাজারে এর কিছুটা প্রভাব পড়ার কথা। কিন্তু সেটা কোনভাবেই এত তাড়াতাড়ি হবার কথা নয়,” বেনারকে বলেন কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ।
দাম বাড়াতে এক শ্রেণির ব্যবসায়ীরা যুদ্ধকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “সরকারের মনিটরিং দুর্বলতার কারণে ব্যবসায়ীরা এই সুযোগ পাচ্ছে।”
এদিকে ইউক্রেন থেকেই বাংলাদেশের গমের বড়ো অংশ আসে উল্লেখ করে সচিবালয়ে নিজ মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সী সাংবাদিকদের বলেন, “এই যুদ্ধ নিয়ে আমি চিন্তিত। এর ফলে খাদ্য মূল্য অবনতি হবার সম্ভাবনা রয়েছে।”
সোমবার নওগাঁয় একটি অনুষ্ঠানে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার জানান, “রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে খাদ্য পণ্যসহ অন্যান্য পণ্যের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। আমদানি নির্ভর পণ্যকে পুঁজি করে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী দেশে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়েছে।”
‘মনে হচ্ছে, দাম আরও বাড়বে’
মিরপুর সাড়ে এগারো এলাকার মুদি দোকানদার সুবল সাহা বেনারকে বলেন, “ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হওয়ায় কয়েক সপ্তাহ থেকেই আটা, তেলের দাম বাড়তে শুরু করেছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরদিন থেকেই এক লাফে দাম বাড়ানো হয়েছে। কোম্পানিগুলো আমাদের কাছ থেকে বাড়তি দাম নিয়ে আমাদের মাল বিক্রি করছে। সেকারণে আমাদেরও দাম বেশি রাখতে হচ্ছে।”
তিনি বলেন, “দেড় মাস আগে প্রতি কেজি আটার দাম ছিল ৩২ টাকা। বর্তমানে সেই আটা বিক্রি হচ্ছে ৪৫ টাকা কেজি। অবস্থা যেমন মনে হচ্ছে, দাম আরও বাড়বে।”
সুবল বলেন, যুদ্ধের আগে একটি পাঁচ লিটার সয়াবিন তেলের বোতল বিক্রি হতো ৬০০ থেকে ৬২০ টাকা। সেই একই বোতল বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৮০০ টাকার বেশি। গত কয়েকদিন ধরে তেল বিপণনকারীরা খুচরা দোকানিদের তেল সরবরাহ করছে না।
কাওরান বাজারের পেঁয়াজ বিক্রেতা মাসুদ রানা বেনারকে জানান, এক দেড় মাস আগে পেঁয়াজের কেজি ছিল ৩০ টাকা। এখন খুচরা বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়। কিছুদিন আগে সেটি ৬৫ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছিল।
“গরিব মানুষ ব্রয়লার মুরগি খায়। আগে ১৭০ টাকায় বিক্রি করেছি। এখন সেই ব্রয়লার মুরগির কেজি ২২০ টাকা,” জানিয়ে খুচরা মুরগি ব্যবসায়ী মো. রফিক বেনারকে বলেন “আমি প্রতিদিন কয়েক ডজন মুরগি বিক্রি করতাম। সেদিন ছয় হালি মুরগি এনে তিন হালি বিক্রি করেছি।”
কাওরান বাজারে বাজার করতে আসা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে মালামাল আসতে তো সময় লাগে। বর্তমানে ব্যবসায়ীরা বলছেন, যুদ্ধ লেগেছে। তারা তো মালামাল কিনেছেন আরও দুই-তিন মাস আগে। তখন তো যুদ্ধ ছিল না। তাহলে দাম বৃদ্ধি কেন?”
“মূলত এদেশের বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন কিছু আমদানিকারক। তারা বিভিন্ন অজুহাতে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে। কোনো সরকারই তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না বা করতে চায় না। অনেক আমদানিকারকরা সরকারের ছত্রছায়ায় থাকে,” বলেন শরিফুল ইসলাম।
‘বেশি লাভের আশায় কৃত্রিম সংকট’
নিশিতা ফ্লাওয়ার মিলস বগুড়ার সত্ত্বাধিকারী নাহিদুজ্জামান নিশাদ বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশে সারা বছর যে পরিমাণ গম প্রয়োজন হয় তার অধিকাংশই আসে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। ইউক্রেনের গম প্রতি কেজি ২৮ টাকায় আমদানি করা যেত এবং ভারতের গম প্রতি কেজি ২৬ অথবা ২৭ টাকায় কেনা যেত।”
“রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ চলার কারণে ভারতীয় রপ্তানিকারকরা গম প্রতি কেজি ৩২ টাকায় বিক্রি করছেন। এখন আমাদের কিছু করার নেই,” বলেন নিশাদ।
কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট গোলাম রহমান বেনারকে বলেন, “আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের একটি প্রবণতা হলো, সারা বছরের লাভ রোজার মাসে করে নিতে হবে। সেকারণে প্রতিবছর রোজার মাসে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়।”
তিনি বলেন, “আবার ক্রেতাদের একটি বড়ো অংশ, বিশেষ করে ধনীরা রোজার মাসে প্রচুর সওদা করেন। ফলে দাম বেড়ে যায় এবং নিম্ন আয়ের মানুষেরা কষ্ট পান।”
ইউক্রেনে যুদ্ধের প্রভাব বাংলাদেশে পড়তে শুরু করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আসলে ইউক্রেনে যুদ্ধের কারণে ভবিষ্যতে কী হবে এই আশঙ্কা থেকে ব্যবসায়ীরা তাদের মজুদ ছেড়ে না দিয়ে ধরে রাখেন, বেশি লাভের আশায় কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেন।”
“পণ্যের দাম কমানোর ব্যাপারে সরকারের আসলে খুব বেশি কিছু করার নেই। পণ্য আমদানিতে সরকার নির্ধারিত শুল্ক কমিয়ে দাম কিছুটা কমানো যেতে পারে। এছাড়া, পণ্য পরিবহনে যাতে কোনো বাধা যেমন চাঁদাবাজি যাতে না হয় সেব্যাপারে সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে,” বলেন গোলাম রহমান।
ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআই এর ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. হেলাল উদ্দিন বেনারকে বলেন, “আমাদের বাজার ব্যবস্থাপনা ও মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতিতে ত্রুটি রয়েছে। কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো ব্যবসায়ীদেরই দায়ী করে। দিনশেষে সরকার ও বিরোধীরাও মূল্যবৃদ্ধির জন্য ব্যবসায়ীদের দিকে আঙ্গুল তোলে।”
রোববার রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সভাপতিত্বে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের ওপর অনুষ্ঠিত উচ্চ পর্যায়ের সভায় নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর ওপর থেকে শুল্ক তুলে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সোমবার এব্যাপারে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
“ইসলাম সংযমের শিক্ষা দেয়। কিন্তু আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষের মধ্যে রোজার মাসে সংযমের কোনো লক্ষ্মণ দেখা যায় না। তাছাড়া ব্যবসায়ীরাও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। এটি আসলেই রোজার মূল আদর্শের সাথে সাংঘর্ষিক,” বেনারকে বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক খাদেমুল ইসলাম।