ইউক্রেনে বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষায় জাতিসংঘ প্রস্তাবনা: পক্ষে বাংলাদেশ, ভোটদানে বিরত ভারত ও পাকিস্তান
2022.03.25
ঢাকা
ইউক্রেনের বেসামরিক মানুষদের রক্ষা ও তাঁদের ত্রাণ সরবরাহের সুযোগ সংক্রান্ত জাতিসংঘ প্রস্তাবনার পক্ষে ভোট দিয়েছে বাংলাদেশ, যদিও ইউক্রেনে সামরিক আক্রমণকে ‘আগ্রাসন’ হিসাবে অভিহিত করে রাশিয়ার সেনা প্রত্যাহার সংক্রান্ত জাতিসংঘ প্রস্তাবনায় ২ মার্চ ভোটদানে বিরত ছিল বাংলাদেশ।
বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে অনুষ্ঠিত এই ভোটাভুটিতে বাংলাদেশসহ ১৪০টি দেশ এর পক্ষে মতামত দেয় বলে জাতিসংঘ ওয়েবসাইটে জানিয়েছে। বিপক্ষে ভোগ পড়েছে পাঁচ ভোট এবং ভারত, পাকিস্তান ও চীনসহ ভোটদানে বিরত ছিল ৩৮টি দেশ।
২ মার্চ ইউক্রেন আক্রমণের জন্য রাশিয়ার বিপক্ষে ভোট না দেয়ায় সমালোচনা করলেও বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষা ও তাঁদের ত্রাণ পৌঁছে দেয়া সংক্রান্ত প্রস্তাবে ভোট দেয়ায় সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন মানবাধিকার কর্মীরা।
“রেজুলেশনের পক্ষে ভোট দেওয়ার মূল কারণ হচ্ছে মানবিকতা। বাংলাদেশ সারা বিশ্বে মানবিক দেশ হিসেবে সুপরিচিত,” শুক্রবার ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।
“যেকোনো যুদ্ধে সাধারণ নাগরিক সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এটি আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা থেকেই জানি,” উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, “আমরা চাই, যারা নির্যাতিত হয়েছে তারা সব ধরনের সুবিধা পাক, সেই জন্য আমরা এ রেজুলেশনে রাজি হয়েছি।”
‘ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা’
জাতিসংঘে বাংলাদেশ ‘মানবতার জন্য’ ভোট দিয়েছে এমন কথার সাথে দ্বিমত করে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন শুক্রবার বেনারকে বলেন, বাংলাদেশ প্রকৃতপক্ষে “ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়া ও পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছে।”
তিনি বলেন, “২ মার্চের প্রস্তাবনা এবং বৃহস্পতিবার যে প্রস্তাবনা আনা হয়েছে সেই দুটোর মধ্যে ভাষাগত তফাত থাকলেও প্রকৃতপক্ষে প্রস্তাব দুটো একই রকম বলে আমি মনে করি। দুটো প্রস্তাবই ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন সংক্রান্ত।”
তাঁর মতে, “দুটো প্রস্তাবে বাংলাদেশের দুই ধরনের অবস্থানের কারণ হলো পররাষ্ট্রনীতির জায়গা থেকে কিছুটা ভারসাম্য রক্ষা করা। প্রথম ভোটাভুটিতে রাশিয়ার বিপক্ষে ভোট না দিয়ে বাংলাদেশ একদিকে কিছুটা হলেও রাশিয়ার কাছে থাকতে পারবে। আবার বৃহস্পতিবারের ভোটাভুটির কারণে পশ্চিমাদেরও কাছে থাকতে পারবে।”
“তবে ইউক্রেনের আক্রমণটি সত্যিই ন্যাক্কারজনক। একটি স্বাধীন, সার্বভৌম দেশের ওপর এরকম আক্রমণ সমর্থন করা যায় না,” বলেন তৌহিদ হোসেন।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমানের মতে, বাংলাদেশ বৃহস্পতিবার ইউক্রেনের বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষা এবং তাঁদের ত্রাণ পৌঁছানো সংক্রান্ত প্রস্তাবনার পক্ষে ভোট দিয়ে “সঠিক কাজটি করেছে।”
“একটি আদর্শিক অবস্থান থেকে বাংলাদেশ এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে বলে আমি মনে করি,” জানিয়ে অধ্যাপক মিজান বলেন, “সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ সবসময় নিপীড়িত জনগণের পক্ষে থাকবে। হয়তো সরকার সেই অবস্থানকে তুলে ধরেছে।”
রাশিয়া ও ইউক্রেন দুটি দেশের সাথেই বাংলাদেশের সুন্দর বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশের বাৎসরিক মোট গমের চাহিদার দুই-তৃতীয়াংশই আসে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে।
রাশিয়ার সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্যের পরিমাণ খুব বেশি নয়। এক দশমিক দুই বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। বর্তমানে রাশিয়ার অর্থায়নে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ।
অন্যদিকে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাজার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের মূল রপ্তানিপণ্য তৈরি পোশাকের প্রায় পুরো বাজারই পশ্চিমা দেশগুলো।
এ ছাড়া, রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যুতে পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশকে অব্যাহত সমর্থন জানালেও রাশিয়া ও চীন জাতিসংঘে মিয়ানমারকে সমর্থন জানিয়ে আসছে। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো প্রস্তাবনা আসলেই সেগুলোর বিরুদ্ধে ভেটো দেয় চীন ও রাশিয়া।
সে কারণে মিয়ানমার জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। গত ২ মার্চ ভোটে রাশিয়ার আগ্রাসনকে নিন্দা করে আনা প্রস্তাবনার বিরুদ্ধে ভোট দেয় মিয়ানমার। তবে বৃহস্পতিবার প্রস্তাবনার পক্ষে ভোট দিয়েছে দেশটি।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়া সামরিক অভিযান শুরু করে। যুদ্ধে গত এক মাসে দুই পক্ষে কয়েক হাজার সামরিক ও বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে বার্তাসংস্থা রয়টার্সসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো।
ইউক্রেনের উপর রাশিয়ার সামরিক অভিযানকে আগ্রাসন হিসেব আখ্যায়িত করে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পাশ্চাত্যের বেশিরভাগ দেশ রাশিয়ার সাথে আর্থিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তবে এখনো রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করেনি বাংলাদেশ।