যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা: মিয়ানমারের দুই ব্যাংকের লেনদেন বন্ধ করেছে সোনালী ব্যাংক
2023.08.16
ঢাকা
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা মিয়ানমারের দু’টি সরকারি ব্যাংকের অর্থ উত্তোলন অপ্রচলনযোগ্য বা ফ্রিজ করেছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংক।
ব্যাংক দু’টি হলো—মিয়ানমার ফরেন ট্রেড ব্যাংক (এমএফটিবি) ও মিয়ানমার ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক (এমআইসিবি)।
সোনালী ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আফজাল করিম বুধবার বেনারকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, “আমরা ইতোমধ্যে দু’টি ব্যাংকের হিসাব ফ্রিজ করেছি। ওফাক (ওএফএসি) নিষেধাজ্ঞা থাকায় এটি করা হয়েছে।”
ওফাক বা অফিস অব ফরেন অ্যাসেটস কন্ট্রোল যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগের আওতাধীন, যার আওতায় দেশটি কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দেশের ওপর অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্র গত ২১ জুন মিয়ানমারের এই দু’টি ব্যাংকসহ তিনটি প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়।
মিয়ানমারে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করে দেশটির বর্তমান শাসন ব্যবস্থা নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে বিশ্বব্যাপী বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। এর মধ্যেই ২০১৬ সালে নির্যাতনের কারণে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।
এদিকে দেশটির আলোচ্য দু’টি ব্যাংকের ওপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে এ বিষয়ে ‘যথাযথ ব্যবস্থা’নিতে বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ জানিয়ে গত ৩ আগস্ট ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস একটি চিঠি পাঠিয়েছে।
একইদিন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চিঠির বিষয়বস্তু অর্থ মন্ত্রণালয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংককে পাঠায়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মীর নুরানী রূপমা স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, “এমএফটিবি ও এমআইসিবির ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কিত একটি নন-পেপারের মাধ্যমে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস সোনালী ব্যাংকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত ব্যাংক দু’টির হিসাব থাকার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছে।”
নন-পেপার হলো যোগাযোগের এমন মাধ্যম, যেখানে অফিসিয়াল সিল বা সাইন ব্যবহার করা হয় না। এটি সাধারণত কোনো বিষয়ে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য পাঠানো হয় বলে বেনারকে জানান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উত্তর আমেরিকা বিভাগের মহাপরিচালক খন্দকার মাসুদুল আলম।
হিসাব কবে অপ্রচলনযোগ্য হয়েছে, সে বিষয়টি খোলাসা করছে না সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। দিনক্ষণ সুনির্দিষ্ট করে না বললেও মো. আফজাল করিম বলেন, “আরও এক থেকে দুই মাস আগেই ব্যাংক দু’টির হিসাবে (সোনালী ব্যাংকে রক্ষিত) লেনদেন হচ্ছে না।”
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের বাণিজ্যের বড়ো অংশই সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে হয়ে থাকে।
চিঠির বিষয়ে জানতে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসে বেনারের পক্ষ থেকে ই-মেইল করা হলেও এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, লেনদেন বন্ধ করার পর তা খুলে দিতে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
আফজাল করিম বলেন, “মিয়ানমার থেকে আমাদের অনুরোধ করা হয়েছিল যাতে হিসাব খুলে দেওয়া হয়। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা না ওঠা পর্যন্ত তা সম্ভব হবে না।”
আটকে আছে ১১ লাখ ডলার
হিসাব বন্ধ করার ফলে সোনালী ব্যাংকে থাকা মিয়ানমারের ব্যাংক দু’টির মোট ১১ লাখ নয় হাজার ডলারের বেশি পরিমাণ অর্থ লেনদেন বন্ধ হয়ে গেছে। যার পরিমাণ বাংলাদেশি টাকায় ১২ কোটি টাকার বেশি।
আফজাল করিম বলেন, “এখানে ভস্ট্রো অ্যাকাউন্টে একটা হিসাবে আছে এক লাখ ১৬ হাজার হাজার ইউরো, আরেকটি হিসাবে আছে এক মিলিয়ন ডলার। এই অর্থ তারা লেনদেন করতে পারবে না।”
ভস্ট্রো অ্যাকাউন্ট হলো বিদেশি কোনো ব্যাংকের বাংলাদেশে থাকা হিসাব, যার মাধ্যমে ওই ব্যাংক এখানে অর্থ পরিশোধ করে থাকে। অন্যদিকে নস্ট্রো হিসাব হলো বিদেশের কোনো ব্যাংকে থাকা এখানকার ব্যাংকের হিসাব, যার মাধ্যমে এখানকার কোনো বাণিজ্যিক লেনদেন হয়ে থাকে।
মিয়ানমারের ব্যাংক দু’টিতেও সোনালী ব্যাংকের নস্ট্রো হিসাব রয়েছে, যার অর্থ যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে আটকে গেছে। সেই অর্থের পরিমাণ জানতে চাইলে আফজাল করিম বলেন, “সেখানে আমাদের তেমন টাকা নেই। একটি ব্যাংকে আছে ১৭ হাজার ইউরো, আরেকটিতে আছে দুই লাখ ডলার।”
বাংলাদেশের অন্য কোনো উপায় নেই
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা থাকলে বাংলাদেশের পক্ষে লেনদেন বন্ধ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাবেক কর্মকর্তা এবং দেশের বেসরকারি খাতের অন্যতম বৃহৎ ব্যাংক—ব্র্যাক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর বেনারকে বলেন, “এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। হিসাব অপ্রচলনযোগ্য করতে হবে। কিছু করার নেই।”
তিনি বলেন, “তাদের এই নিষেধাজ্ঞা আমাদের পরিপালন করতে হবে। না করলে আমাদের ক্ষতি আরও অনেক বেশি হবে।”
মিচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বেনারকে বলেন, “নিষেধাজ্ঞা থাকলে লেনদেন বন্ধ করা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। না করলে আরও বেশি কিছু আসতে পারে।”
মিয়ানমারের সঙ্গে যেহেতু বাংলাদেশের বড়ো অংকের ব্যবসা নেই, এ কারণে উল্লেখযোগ্য সমস্যা হবে না বলেও মনে করেন তিনি।
ব্যবসায়ীদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া
দেশের ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য আরও বেশি বাড়ার সুযোগ ছিল। রোহিঙ্গাসহ বিভিন্ন কারণে ওই সম্ভাবনা দুই দেশই কাজে লাগাতে পারেনি।
তবে নতুন করে ব্যাংকগুলোর হিসাব বন্ধ করে দেওয়ার ফলে তা উভয় দেশের বাণিজ্যকে ক্ষতির মুখে ফেলতে পারে।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সিনিয়র সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “মিয়ানমারে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে। বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের সামনেও সুযোগ রয়েছে বিনিয়োগ ও ব্যবসা বাড়ানোর। যদি ব্যাংক হিসাব বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলে ওই সুযোগ বন্ধ হয়ে যাবে।”
বাংলাদেশ-মিয়ানমার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি এসএম নূরুল হক বেনারকে বলেন, “যারা ব্যবসা করে, তারা বাণিজ্যের স্বার্থেই কোনো না কোনো উপায়ে তা করবে। এর আগেও বিকল্প উপায়ে দেশটির সঙ্গে ঋণপত্র খোলা হয়েছে।”
রোহিঙ্গা ইস্যু ও করোনার কারণে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের প্রত্যাশিত বাণিজ্য হয়নি বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ মিয়ানমার থেকে আমদানি করেছে প্রায় ১২ কোটি ৮৫ লাখ ডলারের পণ্য। আর রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, একই বছরে রপ্তানি করেছে ৩৯ লাখ ডলারের পণ্য।
বাংলাদেশ মিয়ানমারে রপ্তানি করে মূলত আলু, বিস্কিট ও প্লাস্টিক পণ্য। আর আমদানি করে কাঠ, হিমায়িত মাছ, আদা ও পেঁয়াজ।