যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি: একদিন পরেই বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ ভোট, গাজীপুরে বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী
2023.05.25
ঢাকা
বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নীতি ঘোষণার একদিনের মাথায় অনুষ্ঠিত একটি নির্বাচন গত কয়েক বছরের তুলনায় সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সরকার দলীয় প্রার্থীকে পরাজিত করে গাজীপুরের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী।
দিনভর গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য কোনো অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যায়নি। গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বাধা সৃষ্টি করলে জড়িতদের ভিসা দেবে না বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
বৃহস্পতিবার সিটির নির্বাচনে মেয়র পদে বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুন পেয়েছেন মোট প্রায় দুই লাখ ৩৯ হাজার ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো: আজমত উল্লা খান পেয়েছেন প্রায় দুই লাখ ২৩ হাজার ভোট।
বিএনপিসহ অধিকাংশ বিরোধী রাজনৈতিক দল এই নির্বাচনটি বয়কট করলেও ক্ষমতাসীন দলের বিদ্রোহী প্রার্থী থাকায় স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচন নিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে ব্যাপক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।
জায়েদা খাতুন আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত ও পদ থেকে বরখাস্ত গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা। জাহাঙ্গীর এই নির্বাচনে নিজে প্রার্থী হওয়ার চেষ্টা করলেও ঋণ খেলাপি হওয়ার অভিযোগে তাঁর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যায়। পরবর্তীতে তিনি তাঁর মায়ের নির্বাচনী প্রচারে প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করেন।
শেষ পর্যন্ত কোনো প্রকার সহিংসতা ছাড়াই ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে “অত্যন্ত খুশি ও অত্যন্ত সন্তুষ্ট” বলে মন্তব্য করে ঢাকায় নির্বাচন পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেছেন, “কারণ এখানে কোনো কারচুপি ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি।”
শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি কাজ করেছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে মো. আলমগীর “ইসি এই ভিসা নীতির অংশ নয়” জানিয়ে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।
আলমগীর বলেন, “কমিশন প্রাথমিকভাবে অনুমান করেছে যে, সিটি নির্বাচনে ভোট পড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। পাঁচ বছর আগে এই শহরের ভোটে ৫৭ দশমিক শূন্য দুই শতাংশ ভোট পড়েছিল।”
মার্কিন ভিসা নীতি নিয়ে সরকারের বিবৃতি
বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি নিয়ে সরকারের অবস্থান জানিয়ে বৃহস্পতিবার একটি বিবৃতি দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
“বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষণাটিকে দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে সব পর্যায়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে সরকারের দ্ব্যর্থহীন প্রতিশ্রুতির প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করছে। তবে, বাংলাদেশ আশা করে যে এই ভিসা নীতি যথেচ্ছভাবে প্রয়োগের পরিবর্তে বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে অনুসরণ করা হবে,” বলা হয় বিবৃতিতে।
বিবৃতিতে বাংলাদেশের জনগণ তাঁদের গণতান্ত্রিক অধিকার ও ভোটাধিকারের ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন উল্লেখ করে বলা হয়, “জনগণের রায়কে উপেক্ষা করে ভোট কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতা দখলকারী কোনো সরকার টিকে থাকার নজির বাংলাদেশে নেই।”
বাংলাদেশের নির্বাচনী সংস্কার প্রক্রিয়া সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের সঙ্গে পর্যালোচনার মাধ্যমে একটি চলমান প্রক্রিয়া বলে উল্লেখ করা হয় বিবৃতিতে। এতে বলা হয়, “সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনা বিঘ্নিত করার উদ্দেশ্যে কোনো ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠীর যে কোনো অবৈধ প্রচেষ্টা বা হস্তক্ষেপ প্রতিরোধ ও মোকাবিলা করার জন্য সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।”
সামগ্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়া কঠোর নজরদারির আওতায় রাখা হবে এবং এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক স্বীকৃত আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদেরও অংশগ্রহণ থাকবে জানিয়ে বলা হয়, “সরকার আশা করে যে, জাতীয় পর্যায়ে যেসব অগণতান্ত্রিক শক্তি সহিংসতা, অগ্নিসংযোগ ও ধ্বংসযজ্ঞের আশ্রয় নেয় তারা সতর্ক থাকবে এবং সাংবিধানিক বিধান অনুযায়ী নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার অপচেষ্টা থেকে বিরত থাকবে।”
বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীর অব্যাহত অঙ্গীকারের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃঢ় সমর্থনকে বাংলাদেশ সরকার সব সময় ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করে, বলা হয় বিবৃতিতে।
ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েনের সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত একটি বৈঠকের পর কৃষিমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রাজ্জাক তার মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি নিয়ে সরকার চিন্তিত নয়।
“যারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত করবে তাদের জন্য ভিসা নীতি কার্যকর করা হবে। যুক্তরাষ্ট্র গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো কিছুকে সমর্থন করবে না,” বলেন তিনি।
আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাপাকে অবস্থান ব্যাখ্যা করল যুক্তরাষ্ট্র
ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত বৃহস্পতিবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বিরোধী দল বিএনপি ও জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রতিনিধিদের বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা নীতি করার বিষয়ে দেশটির অবস্থান ব্যাখ্যা করতে তাঁর বাসভবনে আমন্ত্রণ জানান।
বৈঠকের পরে দূতাবাসের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে একটি বার্তায় বলা হয়েছে: “আমরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে সমর্থন করি। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে এমন ব্যক্তিদের ভিসা সীমিত করার এই নতুন ভিসা নীতি সবার জন্য প্রযোজ্য। রাষ্ট্রদূত পিটার হাস আজ আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং জাতীয় পার্টির প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।”
পিটার হাসের বাসায় বৈঠক শেষে বিরোধী দল বিএনপি ও জাতীয় পার্টি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বললেও আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দল এড়িয়ে যান।
বিএনপি’র প্রতিনিধি দলের প্রধান দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, তাঁর দল মার্কিন পদক্ষেপকে স্বাগত জানায় এবং ভোট কারচুপির সঙ্গে জড়িত না থাকায় মার্কিন ভিসা নীতি নিয়ে তাঁদের দলের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই।
“আমরা যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। আমি মনে করি, এই পদক্ষেপ অন্তত আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে আয়োজনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে,” বলেন খসরু।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক জানান, তাঁর দলও যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতিকে স্বাগত জানিয়েছে।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশ সংক্রান্ত মার্কিন ভিসা নীতির উদ্দেশ্য বোঝা যাচ্ছে, তারা একটি সুষ্ঠু নির্বাচন চায় এবং নির্বাচনটি প্রতিযোগিতামূলক হোক। আমাদের দলও এই বিষয়ে একমত।”
ভিসা নীতির প্রভাব অনেক
বাংলাদেশে এই ভিসা নীতির প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বেনারকে বলেন, “ভিসা নিষেধাজ্ঞা নীতির প্রভাব যে কোনো ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের চেয়ে অনেক বেশি। কারণ ভিসা বাতিল নীতি একটি প্রতিরোধমূলক এবং বিস্তৃত ব্যবস্থা।”
তিনি বলেন, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি বাংলাদেশি প্রভাবশালী মহলের জন্য ব্যাপক অর্থ বহন করছে। এখানে বিপুল সংখ্যক প্রভাবশালী লোক রয়েছেন, যারা পশ্চিমা দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে পছন্দ করেন।”
“সুতরাং, যাদের যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার ইচ্ছা আছে বা তাদের সন্তানদের শিক্ষার জন্য সেখানে পাঠানোর ইচ্ছা আছে, তাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সতর্ক হওয়া উচিত," যোগ করেন তিনি।
প্রসঙ্গত, সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধাদানকারীদের ভিসা না দেওয়ার বিধান এনে বুধবার বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতি প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।