কড়াকড়িতে ডলার সংকট, ভোগান্তি বেশি ব্যক্তি পর্যায়ে
2023.09.07
ঢাকা
সম্প্রতি বিদেশে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন মাহফুজুর রহমানের স্ত্রী, ভিসাও পেয়েছেন। কিন্তু বৃহস্পতিবার ঢাকার অন্তত ১০টি মানি এক্সচেঞ্জ ঘুরেও স্ত্রীর জন্য প্রয়োজনীয় ডলার কিনতে পারেননি তিনি।
গুলশান-২ নম্বর এলাকার একটি মানি এক্সচেঞ্জ থেকে মাত্র ১৫০ ডলার সংগ্রহ করতে পেয়েছেন তিনি।
ঢাকার মতিঝিল এলাকার এক প্রিন্টিং প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী আলমগীর হোসেন মানিক বেনারকে জানান, এক আত্মীয়ের জন্য বৃহস্পতিবার তিনি পরিচিত এক ব্যবসায়ীর মানি এক্সচেঞ্জ থেকে ১১৭ টাকা দরে ডলার কিনেছেন।
“অপরিচিত কেউ গেলে ডলার পাবেন না,” মন্তব্য করে মানিক জানান তিন মাস আগে অন্য এক আত্মীয়ের জন্য তিনি ১১০ টাকা করে ডলার কিনেছেন।
কেবল এই দুই জন নন, ডলার সংকটে ভোগান্তিতে পড়েছেন শতাধিক মানুষ।
বিদেশে চিকিৎসা, শিক্ষা কিংবা পর্যটক হিসেবে যেতে ডলার কেনার জন্য বেশির ভাগ মানুষকে মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করতে হয়।
গত দুই সপ্তাহ ধরে ঢাকায় মার্কিন ডলারসহ অন্যান্য বিদেশি মুদ্রার সংকট চলছে। ডলারের দামের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টানতে সরকার কড়াকড়ি আরোপ করায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে বলে মনে করছেন ভোগান্তির শিকার মানুষ।
এই প্রতিবেদক গত বুধবার রাজধানীর বনানী ডিএনসিসি মার্কেটে অবস্থিত দুটি মানি চেঞ্জারে গিয়ে ডলার চাইলে তারা জানান, “কোনো ডলার নেই।”
গুলশান-২ এর দু’টি মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের খোঁজ করার পর একটি প্রতিষ্ঠান অল্প কিছু ডলার সরকার নির্ধারিত ১১২ দশমিক ৫০ টাকা দরে বিক্রি করতে রাজি হলেও ভিসাসহ পাসপোর্ট ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের অনুলিপি জমা দেওয়ার শর্ত দেয়।
এদিন গুলশান ঘুরে বৃহস্পতিবার অর্ধেকের বেশি মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান বন্ধ দেখা যায়।
গুলশান-২ এর ল্যান্ডভিউ মার্কেটে অবস্থিত একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক পরিচয় গোপন রাখার শর্তে এই প্রতিবেদককে বলেন, তাঁর পরিচিত একটি দোকান আছে। সেখান থেকে ১৫০ ডলার এনে দিতে পারবেন। কিন্তু প্রতি ডলারে দিতে হবে ১১৮ দশমিক ৫০ টাকা।
অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া গত ৩১ আগস্টের দর অনুযায়ী, প্রতি ডলারের বিনিময় হবে ১০৯ দশমিক ৫০ টাকায়। মানি এক্সচেঞ্জ থেকে কিনতে গেলে সর্বোচ্চ দিতে হয় ১১২ দশমিক ৫০ টাকা।
বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে
রাজধানীর উত্তরায় অবস্থিত আহনাফ ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস নামে একটি প্রতিষ্ঠান বিদেশে যাওয়ার টিকেট প্রক্রিয়াসহ অন্যান্য সেবা দিয়ে থাকে।
প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী রাকিবুল হাসান বেনারকে বলেন, “ডলারের সংকট দেখা দিয়েছে। দাম কমেনি, বরং বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে।”
ক্রেতারা বেনারের সঙ্গে আলাপকালে জানান, ডলারসহ বিদেশি অন্যান্য মুদ্রার সংকট। ভিন্ন উপায়ে কিংবা বিশ্বস্ত কারো মাধ্যমে বেশি দরে কিনতে হচ্ছে। কিছু দোকানে সরকার নির্ধারিত দরে কেনা গেলেও চাহিদার বিপরীতে তা খুবই কম।
গত ২১ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা নির্দেশনায় বলা হয়, বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ অথরাইজড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) থেকে অথরাইজড ডলার ব্যাংকগুলোর নগদ মার্কিন ডলারের গড় মূল্যের তুলনায় মানি এক্সচেঞ্জগুলো সর্বোচ্চ এক টাকা বেশি দরে ডলার কিনতে পারবে। আর বিক্রি হবে সর্বোচ্চ এক দশমিক ৫০ টাকা বাড়তি দরে। সেই হিসাবে বর্তমানে ডলারের ক্রয়মূল্য হবে সর্বোচ্চ ১১১ টাকা আর বিক্রি হবে সর্বোচ্চ ১১২ দশমিক পাঁচ টাকায়।
এই নির্দেশনা অমান্য করায় পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স স্থগিত করার পর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ীদের মধ্যে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমতে শুরু করে এবং সংকট শুরু হয় ডলারের। এরপর ক্রমাগত দাম বাড়তে থাকে ডলারের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ গত ৩১ আগস্ট প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, দেড় বছরে ডলারের বিপরীতে টাকা দর হারিয়েছে প্রায় ২৭ শতাংশ।
আমদানিকারকদের বক্তব্য, সরকারের বেঁধে দেওয়া দরের তুলনায় চার থেকে পাঁচ টাকা বেশি দরে ডলার কিনে আমদানি ব্যয় মেটাতে হচ্ছে তাদের।
ডলার সংকট কাটাতে সরকার চীন ও ভারতের সঙ্গে ডলারের বাইরে দু’দেশের মুদ্রায় লেনদেন চালু করেছে। তা সত্ত্বেও ডলার সংকট কাটছে না। বরং গত জুলাইয়ের পর ডলারের বিপরীতে দুই দফায় টাকার অবমূল্যায়ন করা হয়েছে।
সংকটের মূলে দর নির্ধারণ ও কড়াকড়ি
মানি চেঞ্জার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর সাধারণ সম্পাদক হেলাল সিকদার বেনারকে বলেন, “দর নির্ধারণ করে দেওয়ার কারণে এই সংকট তৈরি হয়েছে। এটা যদি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হতো, তাহলে এই সমস্যা হতো না। এতদিন যিনি ১১৫ টাকা প্রতি ডলারে পেয়েছেন, তিনি কি ১১০ টাকায় বিক্রি করতে চাইবেন?”
ঢাকার ক্রাউন মানি চেঞ্জার কোম্পানির বিক্রয়কর্মী মেহেদী হাসান বেনারকে বলেন, তাঁরা সরকার নির্ধারিত ১১১ টাকায় প্রতি ডলার কিনতে পারছেন না বলে, নির্ধারিত দরে বিক্রিও করতে পারছেন না।
তিনি বলেন, “ডলার বাইরের মানুষের কাছ থেকে কিনতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক এই দরে আমাদের কাছে ডলার বিক্রি করলে আমাদের কোনো সমস্যা হতো না। পাবলিক আমাদের কাছে এই দরে বিক্রি করছে না। তারা যে দেশ থেকে আসে, ওই দেশ থেকেই অনেক বেশি দামে কিনে আনে। তাহলে তিনি আমার কাছে কেন কম দামে বিক্রি করবেন।”
ব্যাংকারদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) এর সাবেক সভাপতি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বেনারকে বলেন, “আগেও কিছু অনিয়ম মানি চেঞ্জাররা করত। কিন্তু তখন তেমন সমস্যা হয়নি। এখন ডলারের সমস্যা হওয়ায় এবং তদারকি বাড়ায় সংকট তৈরি হয়েছে। তারা তো এখন ১১১ টাকায় কিনতে পারছে না, এ জন্য হয়তো সংকট।”
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান মনে করেন, ডলারের দর ঠিক করে দেওয়ার আইনি অধিকার বাফেদার আছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, আশা বাংলাদেশ ব্যাংকের
ডলার নিয়ে বিদ্যমান পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হবে না বলে মনে করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র জাকির হোসেন চৌধুরী। তিনি বেনারকে বলেন, “পরিস্থিতি অবশ্যই ঠিক হবে। আমরা ইতোমধ্যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে নামিয়ে দিয়েছি।”
তিনি বলেন, “মানি এক্সচেঞ্জ এক-দুই টাকা ব্যবসা করবে ঠিক আছে কিন্তু পাঁচ-ছয় টাকা ব্যবসা করবে, কাউন্টারের বাইরে বাইরে ব্যবসা করবে—তা হতে পারে না। তাদের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে দোকানে ব্যবসা করতে।”
ব্যাংকে ডলারের সংকট নেই বলেও জানান তিনি।
হেলাল সিকদারও মনে করেন, সংকট কেটে যাবে। তিনি বলেন, “আমরা নিয়মিত বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাফেদার সঙ্গে বৈঠক করছি। ডলারের সংকট কেটে যাবে এবং দামও কমে আসতে পারে।”