বজ্রপাত: বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে চব্বিশ ঘণ্টায় অন্তত ২৮ মৃত্যু
2023.04.28
ঢাকা ও কলকাতা
কালবৈশাখী ঝড়ের সময় বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত প্রায় ২৪ ঘণ্টায় বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বজ্রপাতে কমপক্ষে ২৮ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করেছে দুই দেশের সংশ্লিষ্ট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, পুলিশ ও প্রশাসন সূত্র।
চলতি বছরে তীব্র গরমের মধ্যে বৃহস্পতিবারই উল্লেখযোগ্য ঝড়ো বৃষ্টি হয়েছে এবং এই দিন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় কমপক্ষে ১৬ জন এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় কমপক্ষে ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে বজ্রপাতে।
শুক্রবার সন্ধ্যা নাগাদ পশ্চিমবঙ্গে কমপক্ষে তিনজন এবং বাংলাদেশে কমপক্ষে একজন বজ্রপাতে মারা গেছেন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ ও সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোর পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সাতক্ষীরা, মেহেরপুর, রাজবাড়ী, যশোর এবং ঝিনাইদহ জেলায় কমপক্ষে আট ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে বজ্রপাতে।
পটুয়াখালী সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মনিরুল ইসলাম বেনারকে জানিয়েছেন, শুক্রবার বিকেল সাড়ে ৫ টার দিকে সদর উপজেলার লাউকাঠী ইউনিয়নে সিপাই বাড়ির পশ্চিম পাশে নিজ জমিতে বজ্রপাতে মৃত্যু হয়েছে একজন কৃষকের।
পশ্চিমবঙ্গে দুই দিনে ১৯ মৃত্যু
বৃহস্পতি থেকে শুক্রবার বিকেলের মধ্যে ২৪ ঘণ্টায় বজ্রপাতে পশ্চিমবঙ্গের পাঁচ জেলায় মোট ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিপর্যয় মোকাবিলা দপ্তরের কর্মকর্তা সৌমেন দত্ত বেনারকে জানিয়েছেন, পশ্চিম মেদিনীপুর, পূর্ব বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, উত্তর ২৪ পরগণা এবং হাওড়ায় এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন কমপক্ষে ২০ জন।
তিনি জানান, বৃহস্পতিবার সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে পূর্ব বর্ধমান ও মুর্শিদাবাদ জেলায়, ৪ জন করে। হাওড়া ও পশ্চিম মেদিনীপুরে মারা গেছেন ৩ জন করে। উত্তর ২৪ পরগণায় মৃত্যু হয়েছে ২ জনের। শুক্রবার পূর্ব বর্ধমানে মারা গেছেন আরো ৩ জন।
এই কর্মকর্তার তথ্য মতে, বজ্রপাতের নিহত অধিকাংশই মাঠে কৃষিকাজে ব্যস্ত ছিলেন।
পূর্ব বর্ধমানের ভাতারের বাসিন্দা শেখ আজগর বেনারকে বলেন, মাঠ থেকে ধান আনার সময় মৃত্যু হয় তাঁর ছেলে মনসুর আলি শেখের।
“আমরা তিন-চার ফুট দূরত্বে ছিলাম। হঠাৎ বিকট আওয়াজ। বিদ্যুৎ চমকালো। আমার মাথা ঘুরে গেল। চোখ খুলতেই দেখি ছেলে জমিতে পড়ে রয়েছে। গায়ে হাত দিয়ে দেখি সব শেষ,” জানান আজগর।
ভারত সরকারের আবহাওয়া দপ্তরের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল (পূর্বাঞ্চল) সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় সাংবাদিকদের বলেন, বৃহস্পতিবার বঙ্গোপসাগর থেকে প্রচুর জলীয় বাষ্প গাঙ্গেয় বাংলায় প্রবেশের ফলে একাধিক বিরাট মাপের মেঘপুঞ্জ তৈরি হয়। এর ফলেই প্রবল বজ্রপাতের ঘটনা ঘটেছে।
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ সমর অধিকারী বেনারকে বলেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার আগেই বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছিল। মানুষ মাঠে কৃষিকাজে ব্যস্ত থাকার ফলেই বিপদ বেশি হয়েছে।
“ঝড়বৃষ্টির সতর্কতার সঙ্গে বজ্রপাতেরও সতর্কতা দেওয়া হয়। নিরাপদ জায়গায় থাকতে বলা হয়। কিন্তু মানুষ তাতে কান দিচ্ছেন না,” বলেন সমর অধিকারী।
তিনি বলেন, ২০২১ সালের ৮ জুন পশ্চিমবঙ্গে বজ্রপাতে একদিনে ২৬ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এদের অধিকাংশ ছিলেন কৃষক ও কৃষি শ্রমিক।
সমর অধিকারী জানান, সাধারণত বায়ুমণ্ডলের উপরের স্তরে মেঘ তৈরি হলে মেঘের দুটি স্তরে ঘর্ষণের ফলে বজ্রপাত হয়। তবে সেই সব বজ্রপাত নিচে মাটিতে পৌঁছায় না। কিন্তু ভূ-পৃষ্ঠের কয়েকশ মিটারের মধ্যে মেঘ তৈরি হলে তা সরাসরি মাটিতে আঘাত হানে। তাতেই মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
ভারতের জাতীয় ক্রাইম ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে গড়ে দুই হাজার ৩৬০ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর জন্য দায়ী বজ্রপাত।
পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, ২০২২ সালে ভারতে মোট ৫৬৬ টি বজ্রপাত রেকর্ড করা হয়।
বাংলাদেশ শীর্ষ দেশের একটি
ইউনাইটেড নেশনস ক্যাপিটাল ফান্ড ডেভেলপমেন্ট (ইউএনসিএফডি) এর ওয়েবসাইটে চলতি বছরের জানুয়ারিতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ পৃথিবীর শীর্ষ দেশগুলোর একটি, যেখানে প্রতিবছর গড়ে তিনশতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়।
এতে বলা হয়, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসরণ বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং গড় বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায়, উত্তর বাংলাদেশ এবং নিকটবর্তী নেপালে শক্তিশালী ঝড়ের ফ্রিকোয়েন্সি এবং তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার ফলে ব্যাপক মাত্রায় বজ্রপাতের ঘটনা ঘটছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরে মহাপরিচালক মোঃ মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, বাংলাদেশে মূলত ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর–এই ৯ মাসে বজ্রপাত হয়। তবে এই ৯ মাসের মধ্যে এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত বজ্রপাত সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে।
বিভিন্ন দেশি-বিদেশি গবেষণায় বাংলাদেশকে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যায় শীর্ষে থাকা দেশগুলোর মধ্যে রাখা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, “এমন এক সময় বজ্রপাত হয় যখন আমাদের দেশে কৃষকরা ফসল তুলতে জমিতে থাকেন। অপরদিকে জনসংখ্যার ঘনত্বও আমাদের বেশি। সব মিলিয়ে আমরা সত্যিই একটি বিপজ্জনক অবস্থায় থাকছি।”
তিনি বলেন, বজ্রপাতের যেহেতু কোনো আগাম বার্তা দেয়া সম্ভব হয় না, সেহেতু সরকার হাওর এলাকায় উঁচু টাওয়ার স্থাপন ও তালগাছ লাগানোসহ নানা উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। কিন্তু এসবে খুব একটা পরিত্রাণ মিলছে না।
তিনি বলেন, যেহেতু এই মৌসুমেই বজ্রপাতের ঘটনা বেশি ঘটে এবং সেটা হয় বৃষ্টির সময় তাই খোলামাঠে কাজ করা কৃষকদের সতর্কতাই হতে পারে মূল প্রতিরোধমূলক কাজ।
তিনি আরও বলেন, প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় তিনশ মানুষ বজ্রপাতে মারা যান।
সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরামের সাধারণ সম্পাদক রাশিম মোল্লা বেনারকে বলেন, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ৮৪ লাখ বজ্রপাত হয়, যার ৭০ শতাংশই হয় এপ্রিল থেকে জুনে।
তিনি জানান, বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনাগুলোর ৭০ শতাংশই ঘটছে কৃষিকাজের সময় এবং মারা যাওয়া ব্যক্তিদের প্রায় ৭০ শতাংশই কৃষক।
“মৃত্যুর ঘটনাগুলোর সাড়ে ১৪ শতাংশ হয় বাড়ি ফেরার পথে এবং ১৩ শতাংশ গোসল কিংবা মাছ ধরার সময় জলাশয়ে,” যোগ করেন তিনি।
রাশিম মোল্লা বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের কারণে বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
একই রকম মন্তব্য করেন মিজানুর রহমানও। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে বজ্রপাতের সম্পর্ক সরাসরি। এর ফলে দেখা যাচ্ছে, বজ্রপাত বেড়েই চলছে।
এ ছাড়া গ্রামাঞ্চলে উঁচু গাছের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পাওয়ায় বজ্রপাতে মানুষ বেশি আক্রান্ত হচ্ছে বলেও মনে করেন তিনি।
বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশ সরকার ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করে। এর ফলে বজ্রপাতে মৃতদের পরিবার সরকারি নিয়ম অনুযায়ী কিছু ভাতা পেয়ে থাকেন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং বেসরকারি সংগঠন ‘ডিজাস্টার ফোরাম’-এর তথ্য মতে, বাংলাদেশে ২০১১ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ১২ বছরে বজ্রাঘাতে মৃত্যুর সংখ্যা ৩ হাজার ১৬২।