বিচারক কামরুন্নাহারের বিচারিক ক্ষমতা জব্দ করেছে আপিল বিভাগ

আহম্মদ ফয়েজ
2021.11.22
ঢাকা
Share on WhatsApp
Share on WhatsApp
বিচারক কামরুন্নাহারের বিচারিক ক্ষমতা জব্দ করেছে আপিল বিভাগ নারীর প্রতি সংবেদনশীল বিচার ব্যবস্থার দাবিতে হাইকোর্টের সামনে মহিলা পরিষদের মানববন্ধন। ১৪ নভেম্বর ২০২১।
[ফোকাস বাংলা]

ধর্ষণ মামলায় উচ্চ আদালত থেকে জামিন স্থগিত থাকা এক আসামিকে জামিন দেওয়ার অপরাধে সোমবার আলোচিত বিচারক মোছা: কামরুন্নাহারের বিচারিক (ফৌজদারি) ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।

রাজধানীর বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনায় করা মামলার রায় ও রায়ের পর্যবেক্ষণ দিয়ে ১১ নভেম্বর থেকে আলোচনায় আসেন এই বিচারক। সোমবার তাঁর বিচারিক ক্ষমতা ‘জব্দ’ করার আদেশ দেয় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ।

এ-সংক্রান্ত শুনানি চলাকালে বিচারকাজের সাথে সংশ্লিষ্ট ছাড়া অন্য কাউকে আদালত কক্ষে থাকতে দেওয়া হয়নি। পরে সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র মোহাম্মদ সাইফুর রহমান সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আদালতের আদেশ গণমাধ্যমকে অবহিত করেন।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সোমবার সকাল সাড়ে নয়টায় কামরুন্নাহার আদালতে সশরীরে উপস্থিত হলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ শুনানি শেষে তাঁর “ফৌজদারি বিচারিক ক্ষমতা সিজ (seize) করা হয়েছে- মর্মে আদেশ প্রদান করেন।”

“পূর্ণাঙ্গ রায় পরবর্তীতে প্রকাশ হবে,” জানানো হয় বিজ্ঞপ্তিতে।

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের এজলাসকক্ষে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের বেঞ্চে বিষয়টির শুনানি হয় বলে বেনারকে জানান আদালতে উপস্থিত আইনজীবী তামিম আহমেদ।

শুনানির আগে ওই বিচারকক্ষ থেকে আদালতের বিভিন্ন অফিসার, আইনজীবী এবং গণমাধ্যমকর্মীদের সরে যেতে বলা হয় বলেও জানান তিনি।

“একটি ধর্ষণ মামলায় স্থগিতাদেশ থাকার পরও ধর্ষণের ঘটনায় আসামিকে জামিন দেওয়ার বিষয়ে ব্যাখ্যা চাইতে তলব করা হয়েছিল কামরুন্নাহারকে,” বলেন তামিম।

আদালতে এদিন রাষ্ট্রপক্ষের শুনানিতে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ দেবনাথ।

যে মামলায় জামিন পেয়েছিলেন ধর্ষণের আসামি

আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর হাতিরঝিল থানায় একটি বেসরকারি টেলিভিশনের একজন উপস্থাপক আসলাম সিকদার নামে একজনের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেন।

ওই মামলায় ২০১৯ সালের ১৮ জুন হাইকোর্ট থেকে জামিন পান আসলাম। পরে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে ওই বছরের ২৫ জুন আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতের নির্দেশে আসলামের জামিন স্থগিত হয়।

একইদিন জামিন স্থগিত করে বিষয়টি আপিল বিভাগের নিয়মিত ও পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠায় চেম্বার আদালত। আবেদনটি আপিল বিভাগে বিচারাধীন থাকা এবং আপিল বিভাগের চেম্বার জজের স্থগিতাদেশ থাকার পরও গত বছরের ২ মার্চ বিচারক কামরুন্নাহার আসলামকে জামিন দেন।

সুপ্রিম কোর্ট স্থগিত করার পরও আসামিকে জামিন দেওয়ার বিষয়টি আপিল বিভাগের নজরে আনেন তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

এর প্রেক্ষিতে গত বছরের ১২ মার্চ আপিল বিভাগ সংশ্লিষ্ট বিচারককে ব্যাখ্যা জানাতে আদালতে ২ এপ্রিল উপস্থিত হতে নির্দেশ দেন। তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে আদালতের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রক্রিয়াটি পিছিয়ে যায়।

এ বিষয়ে গত ১৫ নভেম্বর প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের ভার্চুয়াল বেঞ্চ আদেশ দিয়েছিলেন।

তবে “কী আদেশ দেওয়া হয়েছে, তা আদেশের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পেলে জানা যাবে,” বলে ওই দিন সাংবাদিকদের জানান অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন।

যেভাবে আলোচনায় আসেন বিচারক কামরুন্নাহার

গত ১১ নভেম্বর বিচারকের দায়িত্বে থাকা কামরুন্নাহার রাজধানীর বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণের অভিযোগে ২০১৭ সালে করা মামলার রায়ে পাঁচ আসামির সবাইকে খালাস দেন।

রায়ের সময় মৌখিক নির্দেশনায় তিনি ধর্ষণের ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলে পুলিশকে মামলা না নেওয়ার পর্যবেক্ষণ দেন বলে ঢাকার প্রায় সব গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া তিনি ওই মামলায় ভিকটিমদের হেয় প্রতিপন্ন করে কথা বলেছেন বলেও খবর প্রকাশ হয়। এর প্রেক্ষিতে অধিকারকর্মীরা প্রতিবাদ করেন এবং কয়েকটি কর্মসূচি পালিত হয়।

এই ঘটনার প্রেক্ষিতে ওই বিচারকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা চেয়ে প্রধান বিচারপতির কাছে চিঠি লেখেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

১৪ নভেম্বর সকালে সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র সাইফুর এক বিজ্ঞপ্তিতে জানান, “সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ বিচারপতিদের সঙ্গে আলোচনাক্রমে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ওই বিচারককে আদালতে বসতে নিষেধ করেন। একই সঙ্গে কামরুন্নাহারের বিচারিক ক্ষমতা সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করে বর্তমান কর্মস্থল থেকে তাঁকে প্রত্যাহার করা হয়।”

এছাড়া তাঁকে আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগে সংযুক্ত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আইন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে কামরুন্নাহারকে ট্রাইবুনাল থেকে প্রত্যাহার করে আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগে সংযুক্ত করা হয়।

আইনের অপব্যবহার রোধে সহায়তা করবে

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই দৃষ্টান্ত আইনের অপব্যবহার রোধে সহায়তা করবে। কামরুন্নাহারের বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নেয়ার বিষয়কে বিরল ঘটনা হিসেবে আখ্যায়িত করে এ ধরনের আরো ঘটনা ঘটছে কিনা, তা খতিয়ে দেখার আহবান জানিয়েছেন মহিলা পরিষদের সভাপতি ড. ফওজিয়া মোসলেম।

“দেশে ধর্ষণের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলাগুলোর বেশিরভাগেরই বিচার পাওয়া যায় না। এই বিচার না পাওয়ার পেছনে বহু কারণ থাকে। আইনের অপব্যবহার তার একটি। কামরুন্নাহারের ঘটনা দৃষ্টান্ত তৈরি করবে, এ জন্য সংশ্লিষ্টদের সাধুবাদ জানাই,” বেনারকে বলেন ফওজিয়া।

“এই ধরনের ঘটনা সত্যিই বিরল। এটি মানুষের মধ্যে সাহস বাড়াবে এবং বিভিন্ন পর্যায়ে আইনের অপব্যবহার রোধ করতে ভূমিকা রাখবে,” বেনারকে বলেন সাবকে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট হারুন-অর-রশীদ।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।