নারীর প্রতি অশালীন মন্তব্য: প্রতিমন্ত্রী মুরাদকে পদত্যাগের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

জেসমিন পাপড়ি
2021.12.06
ঢাকা
নারীর প্রতি অশালীন মন্তব্য: প্রতিমন্ত্রী মুরাদকে পদত্যাগের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর ঢাকার একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান। ৭ নভেম্বর ২০২১।
[ফোকাস বাংলা]

নারীর প্রতি বিদ্বেষমূলক ও অশালীন মন্তব্যের জের ধরে শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভা থেকে পদ হারাতে যাচ্ছেন তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. মুরাদ হাসান। প্রধানমন্ত্রী তাঁকে পদত্যাগ করার নির্দেশ দিয়েছেন বলে সোমবার রাতে সাংবাদিকদের জানান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে বলেছেন আগামীকালের (মঙ্গলবার) মধ্যে তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানকে পদত্যাগ করতে। এ বার্তাটি রাত আটটার দিকে আমি মুরাদ হাসানকে জানিয়ে দিয়েছি।”

গত ১ ডিসেম্বর মুরাদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিরোধী দল বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নাতনি ও তারেক রহমানের কন্যা জাইমা রহমানের উদ্দেশ্যে কিছু অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করেন। ভাইরাল হওয়া ভিডিও সাক্ষাৎকারে মুরাদ নিজের খারাপ ভাষার জন্য গর্ব বোধও করেন।

মুরাদের ওই বক্তব্যের সমালোচনায় সোচ্চার হয়েছিলেন নারী অধিকারকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ। শুরু হয় রাজনৈতিক বিতর্ক। দেশের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপির পক্ষ থেকে এই প্রতিমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করা হয়। মুরাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ চায় নারীপক্ষসহ কয়েকটি নারী অধিকার সংগঠন।

এই সমালোচনা উস্কে দেয় বাংলাদেশের একজন চিত্রনায়িকার সাথে প্রতিমন্ত্রী মুরাদের কথোপকথনের রেকর্ড ফাঁস হওয়ার ঘটনায়। ফোনালাপে থাকা চিত্রনায়ক ও চিত্রনায়িকা ইতোমধ্যে স্বীকার করেছেন যে, ফোনের অপর প্রান্তে ছিলেন প্রতিমন্ত্রী মুরাদ।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এই রেকর্ডেও মুরাদকে অত্যন্ত নোংরা ভাষায় ওই নায়িকার সাথে কথা বলতে শোনা যায়। তথ্য প্রতিমন্ত্রী ওই নায়িকাকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়ার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় তুলে আনার হুমকি দেন।

একজন প্রতিমন্ত্রীর যে বক্তব্য শুনলাম তা কেবল রুচিহীনই না, এটা কোনো ভদ্র মানুষের ভাষা হতে পারে না,” বেনারকে বলেন নিজেরা করির সমন্বয়ক ও অধিকারকর্মী খুশি কবির।

যেখানে আমাদের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী ও নারীর ক্ষমতায়নে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন; তাঁরই ক্যাবিনেটে এ ধরনের একজন সদস্য সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে,” বলেন তিনি।

মুরাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে খুশি কবির বলেন, “এমন একটা মানুষ আমাদের সংসদে থাকবে, এদেশের জনগণের প্রতিনিধিত্ব করবে তা মেনে নেয়া যায় না। তার (মুরাদের) বক্তব্য উস্কানিমূলক, অপরাধমূলক। ছোটখাটো বিষয়ে যেখানে মানুষকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ধরা হয় সেখানে এ ধরনের বক্তব্যকে কেন ধরা হচ্ছে না?”

রোববার এক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ দাবি করে নারীপক্ষ বলেছে, “বর্তমান সরকার দাবি করে যে তারা নারীবান্ধব। নারীর প্রতি নূন্যতম সম্মান রেখে কথা বলতে না পারা একজন ব্যক্তি তারপরও কীভাবে এমন পদে বহাল থাকেন?”

রাজনীতি বিশ্লেষক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরীর মতে, “রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য নতুন নয়,” তবে “দেশে গণতন্ত্রের চর্চা না থাকায় কোনো বিষয়ে প্রতিবাদ নেই।”

দেশে উত্তর কোরিয়ার মতো অবস্থা তৈরি হয়েছে। খবরের কাগজ থেকে সুশীল সমাজ-কোনো পক্ষ থেকেই কোনো রকম প্রতিবাদ নেই। এমন একটা সমাজ, যেখানে কোনো শালীনতা নেই, সেখানে মেয়েরা লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনায় অবাক হই না,” বেনারকে বলেন তিনি।

তিনি বলেন, “সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও এ ধরনের কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য বিভিন্ন সময় করেছেন। কিন্তু আমেরিকানরা বিভিন্ন সময় সরাসরি মন্তব্যে, কাগজে কার্টুন এঁকে কিংবা বিভিন্ন উপায়ে বুঝিয়ে দিয়েছে যে, তারা সেটা পছন্দ করেনি। শেষমেশ তারা যেটা করেছে, তাহলো ভোটের মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সেই পরিস্থিতি তো এদেশে নেই।”

২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামালপুর-৪ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়ে প্রথমবার সংসদে যান চিকিৎসাশাস্ত্রে ডিগ্রিধারী মুরাদ হাসান। এরপর ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একই আসন থেকে দ্বিতীয়বার জয়ী হন তিনি।

এই দফায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুরাদ হাসানকে সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। সরকার গঠনের পাঁচ মাসের মাথায় চিকিৎসকদের আপত্তির মুখে ২০১৯ সালের মে মাসে মুরাদ হাসানকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে তথ্য প্রতিমন্ত্রী করা হয়।

জাতি স্তম্ভিত: বিএনপি

জিয়া পরিবারের সদস্যকে নিয়ে অশ্লীল মন্তব্যের প্রতিবাদে সোমবার এক বিবৃতিতে তথ্য প্রতিমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

সোমবার বিএনপির সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু স্বাক্ষরিত গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে মির্জা ফখরুল বলেন, “একজন জাতীয় পতাকাধারী ব্যক্তির এ ধরনের মনোবৈকল্য উৎসারিত বিকৃতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় সমগ্র জাতি স্তম্ভিত হয়েছে।”

সোমবার এক অনুষ্ঠানে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, “প্রতিমন্ত্রীর নারী বিদ্বেষমূলক বক্তব্য তাঁর ব্যক্তিগত। এটা আমাদের দলের বা সরকারের কোনো বক্তব্য বা মন্তব্য নয়। এই ধরনের বক্তব্য কেন সে দিল, অবশ্যই আমি বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করব।”

পরবর্তীতে পদত্যাগের জন্য মুরাদ হাসানকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পৌঁছে দেবার কথা রাতে গণমাধ্যমকে অবহিত করেন ওবায়দুল কাদের।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।