ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ আমলে নিলো আদালত
2024.04.02
ঢাকা
কর্মচারীদের দাবি করা গ্রামীণ টেলিকমের লভ্যাংশের প্রায় ২৬ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও ১২ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দেওয়া অভিযোগপত্র আমলে নিয়েছে ঢাকা মহানগর আদালত।
মঙ্গলবার ঢাকা মহানগর আদালতের জ্যেষ্ঠ বিচারক মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন অভিযোগ গঠনে শুনানির জন্য মামলাটি বিশেষ জজ আদালত-৪ এ পাঠিয়ে দেন। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোশারফ হোসেন কাজল সাংবাদিকদের এ তথ্য জানিয়েছেন।
আগামী ২ মে আদালত অভিযোগ গঠনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিতে পারেন।
বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা অনুযায়ী, অভিযোগ গঠন করা হলে সংশ্লিষ্ট মামলার বিচার শুরু হবে।
ড. ইউনূসের আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুনের ভাষ্য, দুদক অর্থ আত্মসাতের যে অভিযোগ এনেছে, সেটি একেবারে মিথ্যা এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
তিনি জানান, বর্তমানে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে দুটি ফৌজদারিসহ মোট ১৩২টি মামলা চলমান।
শুনানি শেষে আদালত প্রাঙ্গণে ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাংবাদিকদের বলেন, “আইনের শাসন বলে যে একটা জিনিস, সেটা আমরা পাচ্ছি না কোথাও।”
চলতি বছরের শুরুর দিন গ্রামীণ টেলিকমে শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় ড. ইউনূসসহ চারজনকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অর্থ আত্মসাতের মামলায় বিচার শুরু হলে, এটি হবে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে আরেকটি ফৌজদারি মামলা।
দুদকের অভিযোগ
গত বছরের ৩০ মে দুদকের উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।
অভিযোগে বলা হয়, আসামিরা ২৫ কোটি ২২ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। অবৈধভাবে অর্থ স্থানান্তর করা হয়েছে; যা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে অপরাধ।
গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ড. ইউনূস ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল ইসলামসহ প্রতিষ্ঠানটির বোর্ড সদস্যদের উপস্থিতিতে ২০২২ সালের ৯ মে গৃহীত এক সিদ্ধান্ত মোতাবেক ঢাকা ব্যাংকের গুলশান শাখায় ৮ মে একটি ব্যাংক হিসাব খোলা হয়।
গ্রামীণ টেলিকমের কর্মচারীদের পাওনার লভ্যাংশ বিতরণে শ্রমিক ইউনিয়ন ও গ্রামীণ টেলিকমের মধ্যে ওই বছরের ২৭ এপ্রিল একটি সমঝোতা চুক্তি সই হয়েছিল। চুক্তিতে ৮ মে ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়, যা বাস্তবে অসম্ভব।
কাগজপত্র নকল করে এটা করা হয়েছে। দুদকের পক্ষ থেকে বলা হয়, চুক্তি অনুযায়ী ও ১০৮তম বোর্ড সভার (গ্রামীণ টেলিকম) সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২০২২ সালের ১০ মে গ্রামীণ টেলিকমের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের মিরপুর শাখা থেকে ঢাকা ব্যাংকের গুলশান শাখায় ৪৩৭ কোটি এক লাখ ১২ হাজার ৬২১ টাকা স্থানান্তর করা হয়। কর্মচারীদের লভ্যাংশের টাকা বিতরণ না করে তা আত্মসাৎ করা হয়।
ঘটনার সূত্রপাত
গ্রামীণ ট্রাস্টের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান হলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুযায়ী, গ্রামীণ টেলিকমের মোট লাভের শতকরা পাঁচ শতাংশ অর্থ পাবেন বলে দাবি করেন ১০৬ জন সাবেক ও বর্তমান কর্মচারী।
তবে গ্রামীণ টেলিকমের বক্তব্য হলো, কোম্পানি আইন অনুযায়ী এই কোম্পানি অলাভজনক এবং কেউ লাভ নিতে পারেন না। সুতরাং, কর্মচারীদের লভ্যাংশ দেওয়ার শর্তটি প্রযোজ্য নয়।
এই বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য কর্মচারীরা মোট ১১০টি মামলা করেন।
গ্রামীণ টেলিকমের কর্মচারীদের শিক্ষানবিশকাল পার হওয়ার পর স্থায়ী না করা, ছুটির নগদায়ন না করা এবং লভ্যাংশ না দেওয়ার অভিযোগে বাংলাদেশ শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলা দায়ের করে সরকারের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর।
পৃথকভাবে দায়ের করা ১১০টি মামলার কথা গোপন করে ২০২১ সালের ২২ নভেম্বর কোম্পানি আইনের আওতায় উচ্চ আদালতে গ্রামীণ টেলিকমে প্রশাসক নিয়োগের জন্য মামলা করে কর্মচারীদের ইউনিয়ন (সিবিএ)।
গ্রামীণ টেলিকমে কেন প্রশাসক নিয়োগ করা হবে না মর্মে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশে ২০২২ সালের এপ্রিলে আদালত আদেশ দেয়।
এই প্রেক্ষাপটে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানে কর্মচারীদের সঙ্গে সমঝোতায় বসে গ্রামীণ টেলিকম।
২০২২ সালের ২৭ এপ্রিল আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হয়, গ্রামীণ টেলিকম লভ্যাংশ বাবদ মোট ৪৩৭ কোটি টাকা কর্মচারীদের দেবে এবং বিনিময়ে তাঁরা মামলা প্রত্যাহার করে নেবেন।
কর্মচারী ও গ্রামীণ টেলিকমের মধ্যে সমঝোতার বিষয়টি আদালতে জানানোর পর প্রশাসক নিয়োগের মামলাটি খারিজ করে দেয় হাইকোর্ট বিভাগ।
চুক্তি অনুসারে, লভ্যাংশের ওই টাকা দিতে ঢাকা ব্যাংকে একটি বিশেষ হিসাব খোলে গ্রামীণ টেলিকম। তবে কর্মচারীদের লিখিত সম্মতি অনুসারে আইনজীবীদের সম্মানী এবং মামলার খরচ বাবদ মোট টাকা থেকে প্রায় ২৬ কোটি টাকা আলাদা করে সিবিএর হিসাবে পাঠানো হয়।
গ্রামীণ টেলিকমের আইনজীবীর ভাষ্য
আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ওই টাকার মধ্যে ১৬ কোটি টাকা আইনজীবীদের দিয়েছে সিবিএ। নয় কোটি টাকা সিবিএ প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারি ও ট্রেজারার তাঁদের হিসাবে পার করেছেন।
“এখন দুদক বলছে, গ্রামীণ টেলিকম সিবিএর সঙ্গে যোগসাজশ করে অর্থ আত্মসাৎ করেছে, মানি লন্ডারিং করেছে। টাকা তো গ্রামীণ টেলিকম দিয়েই দিয়েছে। গ্রামীণ টেলিকম অথবা ড. ইউনূস কি টাকা নিয়েছেন?” প্রশ্ন রাখেন তিনি।
মামুন বলেন, “একটি শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় টাকা না দেওয়ায় ছয় মাসের জেল দেওয়া হলো। আবার এই মামলায় বলা হচ্ছে, টাকা দিয়ে আত্মসাৎ করা হয়েছে, মানি লন্ডারিং করা হয়েছে। কোন দিকে যাব আমরা?”
কেন ২৭ এপ্রিল সভার সমঝোতা কার্যবিবরণীতে ৮ মে হিসাব খোলা হয়েছে উল্লেখ করা হয়েছে জানতে চাইলে মামুন বলেন, “দুপক্ষের সম্মতিতে হিসাব খোলার তারিখের জায়গাটি ফাঁকা রাখা হয়, হিসাব খোলার পর সেটি বসানো হয়েছে। এটি কোনো জালিয়াতি নয়। আমরা সমঝোতা করেছি সেটি উচ্চ আদালতের রায়ে বলা আছে।”
তিনি বলেন, “আসলে গ্রামীণ টেলিকম যাই করুক না কেন, সরকার ভুল ধরবে। এই অভিযোগ অসত্য, ভিত্তিহীন এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।”
‘আইনের শাসন পাচ্ছি না কোথাও'
শুনানি শেষে আদালত প্রাঙ্গণে ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাংবাদিকদের বলেন, “আমার মাঝে মাঝে দুঃখ হয় এটা নিয়ে, সারা দুনিয়া বাংলাদেশ থেকে শিখতে চায়। আমাদের গৌরব বোধ করার কথা। তা না করে আমরা এমন কাজ করছি, যেন একটা পাপের কাজ করে ফেলেছি আমরা। এমন অনুভূতি হওয়ার তো কোনো কারণ ছিল না।”
“মানুষ যেভাবে বাঁচতে চায়, যেভাবে থাকতে চায়, সেভাবে থাকতে পারছে না। আইনের শাসন বলে যে একটা জিনিস, সেটা আমরা পাচ্ছি না কোথাও,” বলেন ইউনূস।