দানের টাকার ওপর ১২ কোটি টাকা কর দিতে হবে ড. ইউনূসকে

আহম্মদ ফয়েজ
2023.05.31
ঢাকা
দানের টাকার ওপর ১২ কোটি টাকা কর দিতে হবে ড. ইউনূসকে রোমে ইতালির চেম্বার ও ডেপুটি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ১০ জুলাই ২০১৪।
[এএফপি]

নিজ নামে প্রতিষ্ঠিত তিনটি ট্রাস্টে দান করা অর্থের বিপরীতে আয়কর হিসেবে সরকারকে ১২ কোটি টাকা দিতে নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশের উচ্চ আদালত।

তিনটি ট্রাস্টে দান করা অর্থের ওপর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর্তৃক আরোপিত ওই ‘দানকর’-এর বিরুদ্ধে দায়ের করা তিনটি আবেদন খারিজ হয়ে যাওয়ায় ড. ইউনূসকে এই টাকা পরিশোধ করতে হবে।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানিয়েছেন।

বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকার ও বিচারপতি সরদার মো. রাশেদ জাহাঙ্গীরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বুধবার এ রায় দেয়।

অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন এই মামলাগুলোতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

আদালতের এই রায় এখনো পূর্ণাঙ্গ প্রকাশ হয়নি।

ড. ইউনূসের আইনজীবী ব্যারিস্টার মুস্তাফিজুর রহমান খান জানান, ১৯৯০ সালের দানকর আইন অনুযায়ী ২০১১-১৪ করবর্ষে মোট ৭৬ কোটি ৭৩ লাখ টাকা দানের বিপরীতে প্রায় ১২ কোটি ২৮ লাখ ৭৪ হাজার টাকা কর দাবি করে ড. ইউনূসকে ২০১৪ সালে নোটিশ পাঠায় এনবিআর।

“২০১২-১৩ করবর্ষে আট কোটি ১৫ লাখ টাকা দানের বিপরীতে এক কোটি ৬০ লাখ ২১ হাজার টাকা দানকর দাবি করা হয়। আবার ২০১৩-১৪ করবর্ষে সাত কোটি ৬৫ হাজার টাকা দানের বিপরীতে এক কোটি ৫০ লাখ ২১ হাজার টাকা কর দাবি করে নোটিশ দেয় এনবিআর,” বলেন তিনি।

আইন অনুযায়ী, দানের বিপরীতে এনবিআর এই কর দাবি করতে পারে না এমন দাবি তুলে এনবিআরের তিনটি নোটিশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ট্যাক্স আপিল ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন ড. ইউনূস।

২০১৪ সালের ২০ নভেম্বর ড. ইউনূসের আবেদন খারিজ হয়ে গেলে তিনি ২০১৫ সালে হাইকোর্টে তিনটি রিট মামলা করেন।

মুস্তাফিজুর রহমান, “ওই মামলাগুলোর প্রাথমিক শুনানি নিয়ে দানকর দাবির নোটিশের কার্যকারিতা স্থগিত করে ২০১৫ সালে রুল জারি করেন হাইকোর্ট।”

বুধবার আদালতের রায়ের পর অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, “আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, তিনটি ট্রাস্টে তিন করবর্ষে ড. ইউনূসের দেওয়া দানের বিপরীতে কর আরোপ ও কর থেকে তাঁকে অব্যাহতি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক।”

“এই রায়ের ফলে ড. ইউনূসকে আরোপিত দানকর দিতে হবে। যার পরিমাণ ১২ কোটি টাকার বেশি হবে,” বলেন আমিন উদ্দিন।

ড. ইউনূসের আইনজীবী মুস্তাফিজুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, “আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পাওয়ার পর এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”

আইনজীবীরা জানিয়েছেন, অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ট্রাস্ট, ইউনূস ফ্যামিলি ট্রাস্ট ও ইউনূস সেন্টার ট্রাস্ট—নামে এই তিনটি ট্রাস্টে ড. ইউনূস দান করেছেন।

তিনটি ট্রাস্টে তাঁর দান করা অর্থের পরিমাণ ৭৬ কোটি ৭৩ লাখ ৩৪ হাজার টাকা।

পরে ডেপুটি কমিশনার অব ট্যাক্সেস (ডিসিটি) ২০১৪ সালে ড. ইউনূসের আয়কর নথি মূল্যায়ন করার পর দানকৃত অর্থের ওপর দানকর আরোপ করেন।

ইউনূসের নামে কমপক্ষে ৩০টি মামলা

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তাঁর সরকারের অনেক মন্ত্রী ও রাজনীতিক ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে ক্রমাগত সমালোচনা করে আসছেন।

সর্বশেষ মঙ্গলবার গ্রামীণ টেলিকমের কর্মচারী কল্যাণ ফান্ডের ২৫ কোটির বেশি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ড. ইউনূসসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেছে।

ড. ইউনূসের আইনজীবী আবদুল্লাহ আল মামুন বেনারকে বলেন, আয়কর ও শ্রম বিষয়ক নানা ইস্যুতে ড. ইউনূস বর্তমানে কমপক্ষে ৩০টি মামলা মোকাবিলা করছেন।

“উনার (ড. ইউনূসের) প্রতিষ্ঠানের কিছু কিছু কর্মী বিচ্ছিন্নভাবে মামলা করায় সবগুলো মামলার হিসেব আমাদের কাছে নেই। তবে আমরা এতটুকু বলতে পারি বর্তমানে বিভিন্ন ইস্যুতে রিট মামলাসহ কমপক্ষে ৩০টি মামলা আমরা মোকাবেলা করছি।”

মামলার সংখ্যা শতাধিক ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “২০১৭ সালে গ্রামীণ টেলিকমের ১৭৬ জন কর্মচারী ড. ইউনূস ও গ্রামীণ টেলিকমের বিরুদ্ধে শ্রম আদালতে ১০৪টি এবং হাইকোর্টে ছয়টি মিলিয়ে ১১০টি মামলা দায়ের করে।”

পরবর্তীতে প্রায় পাঁচ বছর ধরে চলার পর প্রায় ৪৫০ কোটি টাকার দাবি মেটানো সাপেক্ষে ২০২২ সালের মে মাসে আদালতের বাইরে সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে ১১০টি মামলা প্রত্যাহার হয়, জানান তিনি।

২০০৬ সালে ড. ইউনূস ও তাঁর প্রতিষ্ঠা করা গ্রামীণ ব্যাংক শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পায়। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে তিনি নোবেল পান।

২০০৭ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ‘নাগরিক শক্তি’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নিয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসেন ড. ইউনূস।

এরপর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর থেকে সরকারের উচ্চপদস্থ অনেক ব্যক্তি প্রকাশ্যে ড. ইউনূসের সমালোচনা করেন।

পদ্মা সেতুর বিনিয়োগ থেকে বিশ্বব্যাংকের সরে যাওয়ার কারণ হিসেবে ড. ইউনূসের ভূমিকা ছিল বলে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় দাবি করা হলেও ড. ইউনূস এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন।

সরকারের সঙ্গে টানাপড়েনের প্রেক্ষাপটে এবং বয়স ৬৫ বছর হওয়ায় ড. ইউনূসকে ২০১১ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাব্রতী সংস্থা দি হাঙ্গার প্রজেক্টের কান্ট্রি ডিরেক্টর ও গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট বদিউল আলম মজুমদার বেনারকে বলেন, “কোনো ট্রাস্টে দান করে তার জন্য কর দিতে হলে দাতব্য প্রতিষ্ঠান চালানো কঠিন। এই ধরনের আইন সংশোধন হওয়া প্রয়োজন।”

তাঁর মতে, সার্বিক বিবেচনায় বলা যায় ড. ইউনূস রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছেন।

“আমাদের উচিত ড. ইউনূসের বিশ্বজুড়ে যে খ্যাতি সেটিকে ব্যবহার করা। তা না করে আমরা তাকে অপমান অপদস্থ করছি, এটা লজ্জাজনক,” বলেন বদিউল আলম।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।