‘অপরাধ করিনি, শঙ্কিত নই’: দুদকে জিজ্ঞাসাবাদের পর ড. ইউনূস

কামরান রেজা চৌধুরী
2023.10.05
ঢাকা
‘অপরাধ করিনি, শঙ্কিত নই’: দুদকে জিজ্ঞাসাবাদের পর ড. ইউনূস জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ঢাকায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে আইনজীবীদের সঙ্গে উপস্থিত হবার পর গণমাধ্যমকর্মীদের হাত তুলে অভিবাদন জানাচ্ছেন গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ৫ অক্টোবর ২০২৩।
[বেনারনিউজ]

শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগের পরে এবার দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) সশরীরে এসে অর্থ পাচার সংক্রান্ত জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হলেন শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বেরিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের বিষয়ে শঙ্কিত কি না জানতে চাইলে ড. ইউনূস গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, “আমি অপরাধ করিনি, তাই শঙ্কিত নই।”

এর বাইরে তিনি সাংবাদিকদের সরাসরি কোনো কথা বলেননি। আইনজীবী আব্দুল্লাহ আল মামুন তাঁর পক্ষে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন।

গত ৩০ মে দুদক ড. ইউনূসসহ গ্রামীণ টেলিকমের আরো ১২ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অর্থ পাচার ও অর্থ আত্মসাৎ সংক্রান্ত মামলা দায়েরের পর এই প্রথম তিনি সশরীরে হাজির হয়ে জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হলেন। তিনি তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। 

সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের ভাষ্য, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ হয়রানিমূলক।

এর আগে শতাধিক নোবেল বিজয়ীসহ ১৬০ জন বিশ্ব নাগরিক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে হয়রানি না করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আহ্বান জানিয়ে খোলা চিঠি লেখেন। দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরাও তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়েরকে হয়রানিমূলক আখ্যা দিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন।

তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হয়রানির অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, সরকার ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে কোনো মামলা দায়ের করেনি অথবা তাঁকে হয়রানি করেনি বা করছে না।

“কেউ যদি ট্যাক্স না দেয় আর শ্রমিকের অর্থ আত্মসাৎ করে এবং সেই শ্রমিকের পক্ষে শ্রম আদালতে মামলা হলে আমাদের কি হাতে আছে যে সে বিচার বিন্ধ করে দেবো?” ঢাকায় গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে গত ২৯ আগস্ট বলেন তিনি। 

কেন অর্থ পাচারের অভিযোগ?

দুর্নীতি দমন কমিশনের সচিব মো. মাহবুব হোসেন বৃহস্পতিবার এক লিখিত বক্তব‌্যে সাংবাদিকদের জানান, গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়ন একটি অভিযোগ দাখিল করে। তাতে বলা হয়, ২০১০ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরের গ্রামীণ টেলিকমের নিট মুনাফার শতকরা পাঁচ ভাগ লভ‌্যাংশ বণ্টন করা হয়নি।

গত বছরের ১৪ জুলাই কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর এই অভিযোগের সত‌্যতা পেয়ে একটি প্রতিবেদন দুদকে দাখিল করে।

২০২২ সালের ৩১ জুলাই এ বিষয়ে দুদক একটি অনুসন্ধান টিম গঠন করে। সেই টিম অভিযোগের সত‌্যতা পায় এবং সেই অনুসারে দুদক চলতি বছরের ৩০ মে দণ্ডবিধি ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর আওতায় ড. ইউনূসসহ কোম্পানির আরও ১২ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে।

অভিযোগগুলোর মধ‌্যে রয়েছে, গ্রামীণ টেলিকম কোম্পানির পরিচালনা পরিষদ কর্তৃক শ্রমিক-কর্মচারীদের মধ‌্যে বণ্টনের জন‌্য সংরক্ষিত লভ‌্যাংশের শতকরা পাঁচ ভাগ অর্থ লোপাট, শ্রমিক-কর্মচারীদের পাওনা ৩৬৪ কোটি ১৭ লাখ নয় হাজার ১৪৬ টাকা পরিশোধকালে অবৈধভাবে আইনজ্ঞ ফি ও অন্যান্য ফির নামে অর্থ কর্তন, শ্রমিকদের কল‌্যাণ তহবিলে বরাদ্দকৃত সুদসহ সাড়ে ৪৫ কোটি টাকা বিতরণ না করে আত্মসাৎ এবং দুই হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা মানি লন্ডারিংয়ের মাধ‌্যমে অন‌্যান‌্য সহযোগী প্রতিষ্ঠানের ব‌্যাংক হিসাবে হস্তান্তর। 

আইনজীবীর প্রশ্ন: মানি লন্ডারিং হলো কোথায়?

দুদকের অভিযোগের ব‌্যাপারে ব‌্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “গ্রামীণ টেলিকম কোনো লাভজনক প্রতিষ্ঠান নয়। এটি কোম্পানি আইনের ২৮ ধারা অনুসারে নিবন্ধিত। এই ধারার আওতায় প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলো লাভ নিতে পারে না এবং লভ‌্যাংশ দিতেও পারে না। কোম্পানির লাভ গরিব-দুস্থ মানুষের স্বাস্থ‌্য, শিক্ষাসহ তাদের কল‌্যাণে ব‌্যয় করা হয়।”

তিনি বলেন, “একটি মহলের প্ররোচনায় গ্রামীণ টেলিকমের সাবেক ১০৭ কর্মকর্তা-কর্মচারী ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে শ্রম আদালতে মামলা করেন এবং তারা লভ‌্যাংশ দাবি করেন। এই মামলা চলমান।” 

আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, “শ্রমিক-কর্মচারীরা একটি ইউনিয়ন গঠন মামলা পরিচালনা করছেন। তাঁরা শ্রম আদালতে চলমান মামলার কথা গোপন করে উচ্চ আদালতে গ্রামীণ টেলিকম কোম্পানি অবসান ঘটানোর জন‌্য আবেদন করেন।”

“এই অবস্থায় নিরুপায় হয়ে আইনে প্রাপ‌্যতা না থাকার পরও গ্রামীণ টেলিকম পরিচালনা পরিষদ ৪৩৭ কোটি টাকা শ্রমিকদের মধ‌্যে পরিশোধ করতে রাজি হয়। এ ব‌্যাপারে গ্রামীণ টেলিকম ও শ্রমিকদের মধ‌্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যে, ইউনিয়নের মাধ‌্যমে টাকা পরিশোধ করলে তাদের কোনো আপত্তি নেই,” বলেন তিনি।

সেই চুক্তি অনুযায়ী ৮ মে টাকা দিয়ে দেয়া হয়েছে জানিয়ে আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, “শ্রমিক-কর্মচারীদের লিখিত মতামতের ভিত্তিতে শ্রমিক ইউনিয়নের মাধ‌্যমে তাঁদের আইনজীবীদের টাকা এবং মামলার খরচ বাবদ মোট টাকার শতকরা ছয় ভাগ অর্থাৎ প্রায় ২৬ কোটি টাকা প্রদান করা হয়।”

তিনি বলেন, “দুদক বলছে এই ২৬ কোটি টাকা কর্মীদের না দিয়ে লোপাট করা হয়েছে, মানি লন্ডারিং করা হয়েছে এবং শ্রমিকদের স্বাক্ষরিত চুক্তিটি ভুয়া। আমরা তো টাকা ইউনিয়নের হিসাবে দিয়ে দিয়েছি। ওই হিসাবের ওপর গ্রামীণ টেলিকমের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। মানি লন্ডারিং হলো কোথায়? আর দুই পক্ষই চুক্তিটি মানছেন, তাহলে ভুয়া হলো কীভাবে?”

ঢাকা বিশ্ববিদ‌্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ‌্যাপক ড. সি. আর আবরারের মতে, ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে দুদক অর্থ পাচারের যে মামলা দায়ের করেছে সেটি “খুব বেশি কনভিনসিং নয়।”

“একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমি মনে করি, ড. ইউনূস মানি লন্ডারিং করেননি। হয়তো অন‌্য কোনো কারণে তাঁর বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযোগ আনা হচ্ছে,” বেনারকে বলেন সি আর আবরার।

“এই ধরনের যুক্তিহীন মামলা দায়েরের মাধ‌্যমে তাঁর মতো একজন সম্মানিত ব‌্যক্তিকে হয়রানি করা হচ্ছে,” মনে করেন তিনি।

ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত মোট ১৬৮টি মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে বেনারকে জানান তাঁর আইনজীবী আব্দুল্লাহ আল মামুন।

দুদকের পক্ষ থেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে হয়রানির অভিযোগ অস্বীকার করে সচিব মো. মাহবুব হোসেন লিখিত বক্তব‌্যে বলেছেন, “দুদক কর্তৃক হয়রানির অভিযোগ সঠিক নয়।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।